Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

গুরু দায়িত্ব আসিয়ার ঘাড়ে, স্কুল চলছে কোনও মতে

ভাঙা অ্যাসবেস্টসের চালা। ইটের গাঁথনির ঘরে পলেস্তারা নেই। অসমান মাটির মেঝেতে ইঁদুর গর্ত করে দিয়েছে। কাঠের রেলিংয়ের জানালার পাল্লাও নেই। বেঞ্চ সাকুল্যে তিনজোড়া। ঘরের উঠোনেই পুকুর। আর পাশেই মৃদঙ্গভাঙ্গা নদী। মথুরাপুর ২ ব্লকের নন্দকুমারপুর পঞ্চায়েত এলাকার মহবতনগর আদিবাসী পাড়ার ভূপেন্দ্র স্মৃতি অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এটি হল বাইরের ছবি। অন্দরের ছবি আরও করুণ।

তখন পড়াতে ব্যস্ত আসিয়া।—নিজস্ব চিত্র।

তখন পড়াতে ব্যস্ত আসিয়া।—নিজস্ব চিত্র।

অমিত কর মহাপাত্র
মথুরাপুর শেষ আপডেট: ২৫ মে ২০১৫ ০০:৫৬
Share: Save:

ভাঙা অ্যাসবেস্টসের চালা। ইটের গাঁথনির ঘরে পলেস্তারা নেই। অসমান মাটির মেঝেতে ইঁদুর গর্ত করে দিয়েছে। কাঠের রেলিংয়ের জানালার পাল্লাও নেই। বেঞ্চ সাকুল্যে তিনজোড়া। ঘরের উঠোনেই পুকুর। আর পাশেই মৃদঙ্গভাঙ্গা নদী। মথুরাপুর ২ ব্লকের নন্দকুমারপুর পঞ্চায়েত এলাকার মহবতনগর আদিবাসী পাড়ার ভূপেন্দ্র স্মৃতি অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এটি হল বাইরের ছবি। অন্দরের ছবি আরও করুণ।

স্কুল ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, গ্রামেরই এক পরিবার ২০০২ সালে স্কুল গড়ার জন্য দশ কাঠা জমি দান করেন। ওই বছরই সরকারি অনুমোদন ও অনুদানে স্কুলটি তৈরি করা হয়। কিন্তু প্রত্যন্ত এলাকার এই স্কুলটি আট বছর ধরে চালুই হয়নি। তখন এই স্কুলে অবশ্য শিক্ষকও নিয়োগ হয়নি। ২০১০ সালে প্রথম একজন শিক্ষক নিয়োগ হয়। তখন ১৫ জন পড়ুয়া নিয়ে স্কুলটি চালু হয়। বর্তমানে ৬৮ জন পড়ুয়া থাকলেও অবস্থা বদলায়নি। জমিদাতা পরিবারের সদস্য প্রতাপ মাইতি বলেন, “গ্রামের এই অংশে তফসিলি জাতি ও সংখ্যালঘুদের বাস। বেশিরভাগই দুঃস্থ পরিবার। কাছাকাছি কোনও স্কুল না থাকায় প্রাথমিক শিক্ষাতেও এলাকা পিছিয়ে। কিন্তু এই স্কুলের জন্য সরকার কোনও দায়িত্ব নিতে চায় না।”

সে কারণে এলাকাবাসীও ক্ষুব্ধ। গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান মুজিবর রহমান খান বলেন, “বিভিন্ন মহল থেকে সরকারি সংশ্লিষ্ট বিভাগের সব স্তরেই জানানো হয়েছে। কিন্তু কোনও সাড়া পাওয়া যায়নি। স্কুলের হাল ফেরানোর লক্ষ্যে আমরা গ্রামবাসীরা মিলে পড়ুয়াদের নিয়ে দ্রুত আন্দোলনে নামব।” স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য তথা গ্রামশিক্ষা কমিটির সম্পাদক মেনকা ঘোড়াই। ক্ষোভের সঙ্গে তিনি বলেন, “এক জন মাত্র শিক্ষক। তিনি ৮৪ কিলোমিটার রাস্তা পেরিয়ে বারুইপুরের গ্রাম থেকে এসে পৌঁছন সকাল সাড়ে ১১টার পরে। চলেও যান তাড়াতাড়ি। আবার প্রত্যেক দিন স্কুলে আসেন না। পরিস্থিতি অনুযায়ী আমরা এই ব্যবস্থা মেনে নিয়েছি। কিন্তু এ ভাবে স্কুল চলতে পারে না।”

এই পরিস্থিতিতে গ্রামবাসীরা সিদ্ধান্ত নেন, গ্রামেরই কোনও শিক্ষিত বেকারের হাতে স্কুলের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হবে।

এই কাজে এগিয়ে আসেন জমিদাতা পরিবারের তরুণ সদস্য পবিত্র মাইতি। গ্রামের আর এক মহিলা আসিয়া বিবিও অনেকটা দায়িত্ব নেন। তাঁর মেয়েও পড়ে এই স্কুলে।

পরিস্থতি কিছুটা শুধরোতে শুরু করেছিল। কিন্তু বছর দেড়েক আগে অন্য কাজ নিয়ে দিল্লি চলে যান পবিত্র। তারপর থেকে প্রায় দেড় বছর ধরে সব দায়িত্ব একার কাঁধে নিয়ে চলেছেন আসিয়া। কী রকম সে দায়িত্ব? বাড়ি বাড়ি থেকে বাচ্চাদের স্কুলে নিয়ে আসা, স্কুল খোলা, ঝাঁট দেওয়া, স্কুলে প্রার্থনার ব্যবস্থা করা। তা ছাড়া, পড়ানোর দায়িত্ব তো আছেই। এরই ফাঁকে চলে রান্নার তদারকি, বাচ্চাদের স্কুল পালানো আটকানো। স্কুল ছুটির পর খুদে পড়ুয়াদের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ায়ও তাঁর কর্তব্য বলে মনে করেন অসিয়া। তা ছাড়া, ছেলেমেয়েদের পরীক্ষার খাতা দেখা, গ্রামশিক্ষা কমিটির সঙ্গে যাবতীয় যোগাযোগ রক্ষা করা, সকাল সন্ধ্যা বাচ্চাদের পড়াতেও দ্বিধাবোধ করেন না তিনি। বললেন, “স্কুলে নিয়মিত চল্লিশ জনেরও কম পড়ুয়া আসে। তাদের মধ্যে ২৫ জনকে আমি নিয়ে আসি। নদীর পাড়ের কাঁচা মাটির দীর্ঘ পথ ধরে আসতে হয়।’’ এই রাস্তায় ছেলেমেয়েদের একা ছাড়তে অভিভাবকেরা ভয় পান। এত কিছু করার পরেও আসিয়ার আক্ষেপ, “স্কুলের এই অবস্থার জন্য অনেক অভিভাবক স্কুলে নাম লিখিয়েও বাচ্চাদের অন্যত্র পড়ান। অনেকে অন্য স্কুলে ভর্তি করাচ্ছেন। আমি একা এত কিছু সামলে উঠতে পারছি না। শুধুমাত্র গ্রামের প্রতিষ্ঠান বলে শিক্ষার স্বার্থে যা কিছু করছি। কিন্তু এ ভাবে কত দিন সম্ভব হবে জানি না।”

আসিয়া বিবির পারিশ্রমিক বলতে অবশ্য মাত্র পাঁচশো টাকা। অভিভাবকেরা চাঁদা তুলে এই টাকা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এই টাকার দায়িত্ব নেন স্কুলের রান্নার কাজে নিযুক্ত বুলু জানা। বুলুদেবী স্কুলের রান্নার কাজে নিযুক্ত স্বনির্ভর গোষ্ঠীর দলনেত্রী। তিনি বলেন, “গ্রামের বাচ্চারাই তো পড়ে। এরা না এলে বাচ্চারাও আসবে না। স্কুল যদি উঠে যায়! তাই সকলে মিলে কাজ করে আর একটু স্বার্থত্যাগ করে স্কুল বাঁচিয়ে রেখেছি।”

মেঝেতে পলিথিন পাতিয়ে বসে পড়ুয়ারা। রনজিৎ টুং, সাবিনা খাতুনরা বলে, “বেঞ্চে বসা নিয়ে নিয়মিত হাতাহাতি হয় বন্ধুদের মধ্যে। বেঞ্চে ঠাসাঠাসি করে বসে লিখতে কষ্ট হয়।” পূজা সর্দার, শেখ সাকিলরা বলে, “ভাঙা চালা দিয়ে রোদ-বৃষ্টি গায়ে পড়ে। পাশের ঘরে রান্না হয় বলে ক্লাসে ধোঁয়া ঢুকে যায়। খুব কষ্ট হয়।” অভিভাবক জিয়াদ শেখ, স্বপন পাইকরা জানালেন, আসিয়ার ভরসায় বাচ্চাদের স্কুলে পাঠান। কোনও বিষয়েই ওই শিক্ষককে গ্রামের কেউই ভরসা করেন না।

শিক্ষক অমলকুমার নস্কর অবশ্য অসহায় ভাবে বললেন, “বাড়ি থেকে দূরত্ব ও যাত্রার ক্লান্তির কারণে আমি একশো শতাংশ দিতে পারি না। অন্তত আরও একজন শিক্ষক দরকার। না হলে আমার বদলি করা হোক। আবেদনের কোনওটাই কাজে আসেনি।’’ ওই শিক্ষকের কথায়, ‘‘স্কুলের উন্নতির জন্য লাগাতার আবেদন করে গিয়েছি। সাড়া পাইনি। রান্নাঘর তৈরির জন্য টাকা পড়ে থাকলেও কাজ শুরু করা যাচ্ছে না।’’

মথুরাপুর পূর্ব চক্রের ভারপ্রাপ্ত অবর বিদ্যালয় পরিদর্শক নকুল গায়েন বলেন, “স্কুলের এমন অবস্থার কথা আমার জানাই ছিল না। পিছিয়ে পড়া এলাকার পিছিয়ে থাকা ওই স্কুলে যাব। কয়েক মাসের মধ্যেই শিক্ষক নিয়োগের কাজ হবে। স্কুলঘরের উন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করা হবে।” জেলা স্কুল পরিদর্শক উদয়ন ভৌমিক বলেন, ‘‘আইনি জটিলতায় ওই স্কুল-সহ আরও কিছু স্কুলে শক্ষক নিয়োগ করা যাচ্ছে না।’’ পরিকাঠামো-সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে তাঁর বক্তব্য, ‘‘বিষয়টি খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE