Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

প্রকল্প নিয়ে সংশয়ে তৃণমূলের একাংশ

গত বৃহস্পতি এবং মঙ্গলবার— সাত দিনের মধ্যে দু’বার অশান্ত হয়েছে ভাঙড়। বোমাবাজি, মারধর, মোটরবাইক-গাড়িতে অগ্নিসংযোগ— বাদ যায়নি কিছুই।

আরাবুল ইসলাম

আরাবুল ইসলাম

শুভাশিস ঘটক
ভাঙড় শেষ আপডেট: ০৪ জানুয়ারি ২০১৮ ০২:৩৪
Share: Save:

এক বছরে তাঁর বিরুদ্ধে জমি দখলের তেমন কোনও অভিযোগ ওঠেনি। শোনা যায়নি হুমকি-শাসানির অভিযোগও। তা সত্ত্বেও ফের তিনি পথে নামতেই ফের তাতছে ভাঙড়! তিনি— ভাঙড়ে শাসকদলের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা আরাবুল ইসলাম।

গত বছরের গোড়ায় পাওয়ার গ্রিড বিরোধী আন্দোলন অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠার কারণ খুঁজতে গিয়ে যাঁর নাম পেয়েছিলেন গোয়েন্দারা। তদন্তকারীরা জানিয়েছিলেন, জমি দখল এবং দাদাগিরি-তোলাবাজি করে সাধারণ মানুষের একাংশকে চটিয়ে তুলেছিলেন আরাবুল। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছিল যে, আরাবুল-বিরোধী তৃণমূল কর্মী খুনের পরেও থানায় গিয়ে অভিযোগ জানাতে পারেননি নিহতের পরিবারের লোকেরা। থানায় বসে আরাবুল অভিযোগপত্র ছিঁড়ে ফেলে দেন বলে অভিযোগ। এমনই নানা ক্ষোভকেই কাজে লাগিয়ে গ্রামবাসীদের সঙ্ঘবদ্ধ করেছিলেন নকশাল নেতারা। আন্দোলনে নেমে আরাবুলকেই প্রথমে ‘এলাকাছাড়া’ করেন তাঁরা। সেই ক্ষোভই কি আবার সামনে আসছে?

গত বৃহস্পতি এবং মঙ্গলবার— সাত দিনের মধ্যে দু’বার অশান্ত হয়েছে ভাঙড়। বোমাবাজি, মারধর, মোটরবাইক-গাড়িতে অগ্নিসংযোগ— বাদ যায়নি কিছুই। এই তপ্ত আবহের পিছনে কি ফের সেই ‘আরাবুল ফ্যাক্টর’? উঠছে প্রশ্ন। গোয়েন্দাদের একাংশ মনে করছেন, গ্রামবাসীদের আরাবুল-বিরোধিতা এখনও কমেনি। তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটছে।

পাওয়ার গ্রিড বিরোধী আন্দোলনটা হয়েছিল প্রশাসনের বিরুদ্ধে। আক্রান্ত হয়েছিল পুলিশ। কিন্তু গোলমালের সময় মহিলা পুলিশকর্মীদের নিরাপদে বের করে দিয়েছিলেন গ্রামবাসী। যা থেকেও গোয়েন্দাদের মনে হয়েছে, শুধু পুলিশ পেটানোই গ্রামবাসীদের উদ্দেশ্য ছিল না। আরাবুল-বিরোধী ক্ষোভকে তাঁরা প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন। একাধিক তৃণমূল নেতাও তখন আরাবুলের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছিলেন। কিন্তু এখন স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশও স্বীকার করছেন, পাওয়ার গ্রিডের কাজ শেষ করতে হলে আরাবুল ছাড়া উপায় নেই। কারণ, প্রকল্পটি মাছিভাঙা গ্রামে হলেও পাশের পোলেরহাট এবং নতুনহাট আরাবুলের ‘খাসতালুক’। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যতই গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব মিটিয়ে দলের যুযুধান চার নেতাকে (রেজ্জাক মোল্লা, আরাবুল, কাইজার আহমেদ এবং নানু হোসেন) একজোট হয়ে কাজ করার নির্দেশ দিন, এখানে আরাবুলই সব। গ্রিডের কাজ শেষ করতে হলে বা আন্দোলনকারীদের ‘সবক’ শেখাতে আরাবুল-অনুগামীরাই ভরসা। তাই তাঁর বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

গোয়েন্দাদের আর এক অংশের অবশ্য অন্য মতও রয়েছে। তাঁরা মনে করছেন, সময়ের নিয়মে আরাবুল-বিরোধী ক্ষোভ কমেছে। গত বছর গ্রিড-বিরোধী আন্দোলনের পরে পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে দফায় দফায় গ্রামবাসীদের সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। মাস চারেক আগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও ভাঙড়ে সভা করে গ্রামবাসীদের আশ্বস্ত করেছেন। কোনও নেতার প্রতি কোনও ক্ষোভ থাকলে তাঁকে সরাসরি জানাতে অনুরোধও করেন। এতেও গ্রামবাসীদের ক্ষোভ কমে।

নতুন করে অশান্তির পিছনে গোয়েন্দাদের ওই অংশ মনে করছেন, এখন যা হচ্ছে, তার পিছনে শুধু মাছিভাঙা এবং খামারআইট গ্রামের কিছু লোক রয়েছেন। যাঁদের নকশাল নেতারা উস্কানি দিচ্ছেন। ওই দুই গ্রামেই পাওয়ার গ্রিডের প্রকল্প হয়েছে। গোয়েন্দা সূত্রে খবর, নকশাল নেতারা গ্রামবাসীদের বোঝাচ্ছেন, প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেলে জমি ফেরত পাওয়া যাবে। এতে মদত রয়েছে দুই গ্রামের কিছু বেআইনি মেছোভেড়ি এবং ইটভাটার মালিকদেরও। আন্দোলনের খরচও জোগাচ্ছেন তাঁরা। এক পুলিশকর্তার কথায়, ‘‘পাওয়ার গ্রিড চালু হলেই ওই সব বেআইনি ভেড়ি-ভাটা প্রশাসনের নজরে চলে আসবে। তা বন্ধ হয়ে যাবে। সেই কারণেই ওঁরা আন্দোলনে আর্থিক সাহায্য চালিয়ে যাচ্ছেন।’’

পাওয়ার গ্রিড প্রকল্পের জন্য দুই গ্রামের বাসিন্দাদের পাশে পাওয়া যে জরুরি তা মানছে শাসকদল। তার জন্য গ্রামবাসীদের বুঝিয়ে মুলস্রোতে ফিরিয়ে আনার কাজটা জনপ্রতিনিধিরাই য়ে ভাল করতে পারেন, তা স্বীকার করছে পুলিশও। তাই কি ফের ময়দানে আরাবুল? শুরু হয়েছে জল্পনা।

আরাবুল বলছেন, ‘‘একসঙ্গে আমরা সবাই পাওয়ার গ্রিড প্রকল্প করব, এটাই মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ।’’ তাঁর বিরোধী হিসেবে পরিচিত, এলাকার বিধায়ক রেজ্জাক বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী নির্দেশে কাজ করা হচ্ছে। এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে পারব না।’’ কাইজারের কথায়, ‘‘আমরা একসঙ্গেই রয়েছি।’’

কিন্তু শাসকদলের কর্মী-সমর্থকরা বলছেন, প্রকল্পের জন্য আরাবুল বিনে গীত নেই। আর সেখানেই সংশয় স্থানীয় নেতৃত্বের একাংশের। যে আরাবুলকে ঘিরে ভাঙড়-কাণ্ডের সূচনা, তাঁকে ফের প্রকল্পের কাজে সামিল করা হয়েছে। কিন্তু তাতে প্রকল্পের কাজ আদৌ কতটা মসৃণ ভাবে হবে, প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Power Grid project Arabul Islam Bhangar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE