Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

কালো সুদিন ফিরবে কবে, প্রশ্নে বিপাকে রাজনীতি

তখন ‘কাজ’ ছিল বটে... গতর খাটানোর ফাঁকে একটু জিরোনোরও ফুরসত পেতেন না নুন্ডি গ্রামের বুধু বাউড়িরা। দিনে যা খাটাখাটনি তা তো ছিলই, রাতে ‘কাজ’ করলে মিলত আরও বেশি মজুরি। তাই সাঁঝের পরে বাড়ির বিটিছিলারাও নাম লেখাত ‘খাদানবাবু’র খাতায়। আর সেই নেশাতেই গোটা রাত জেগে থাকত জামুড়িয়ার মদনতোড়, বালানপুর কিংবা বিলকুলটির মতো একের পর এক গ্রাম। কালো কালো সব শরীরগুলো পিচুটি চোখে চেয়ে থাকত খাদানের দিকে। কয়লা উঠলেই তা নিয়ে দৌড় লাগাবে মালিকের আস্তানায়।

দেবজিৎ ভট্টাচার্য
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০১৪ ০২:২৬
Share: Save:

তখন ‘কাজ’ ছিল বটে...

গতর খাটানোর ফাঁকে একটু জিরোনোরও ফুরসত পেতেন না নুন্ডি গ্রামের বুধু বাউড়িরা। দিনে যা খাটাখাটনি তা তো ছিলই, রাতে ‘কাজ’ করলে মিলত আরও বেশি মজুরি। তাই সাঁঝের পরে বাড়ির বিটিছিলারাও নাম লেখাত ‘খাদানবাবু’র খাতায়।

আর সেই নেশাতেই গোটা রাত জেগে থাকত জামুড়িয়ার মদনতোড়, বালানপুর কিংবা বিলকুলটির মতো একের পর এক গ্রাম। কালো কালো সব শরীরগুলো পিচুটি চোখে চেয়ে থাকত খাদানের দিকে। কয়লা উঠলেই তা নিয়ে দৌড় লাগাবে মালিকের আস্তানায়।

ওই দৌড়েই লটকে ছিল মজুরি। আর রাত জাগায় ছিল ‘কয়লাবাবু’র প্রতি জান হাজির আনুগত্য। গরিব, অশিক্ষিত মানুষগুলোকে বছরের পর বছর ভাত-রুটি জুটিয়ে তাঁদের বিবেক নিজেদের কাছে বন্ধক রাখত কয়লা পাচারকারীরা। আর রাজনীতির বাবুরা তারই ফসল ঘরে তুলতেন— কারও পেটে লাথি পড়তে না দেওয়ার আশ্বাসে।

বছর তিনেক আগে সেই ঘরেই আগল তুলেছিল তৃণমূল। রাজ্যে সরকার বদলের পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে বেআইনি কয়লা তোলা পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হয়। ভবিষ্যতে কী হবে তা পরের কথা। কিন্তু শহর যে আপাতত পুরনো চেহারায় ফিরছে না, সে বিশ্বাস কার্যত বদ্ধমূল হয়েছে খনি-রাজনীতিতে।

পুরনো আশ্বাস এখন তাই গলার কাঁটা।

বেআইনি কয়লা তোলা বন্ধ হওয়ায় আসানসোলের বিস্তীর্ণ এলাকার লক্ষ লক্ষ মানুষ রাতারাতি ‘কর্মহীন’। তাই লোকসভা ভোটের আগে প্রমাদ গুনছে ডান-বাম সবাই। বুধুদের পেটের টান কী ভাবে নগদে চোকানো যায়, সেই পথ খোঁজাই এখন দায় নেতাদের। যেমন রানিগঞ্জের এক তৃণমূল নেতা বলছেন, “গ্রামে গেলেই লোক হামলে পড়ছে। প্রশ্ন একটাই, কয়লা কবে চলবে? কী জবাব দেব, বলুন তো?” গ্রামে কান পাতলে শোনা যায়, দেড় বছর আগে পর্যন্ত শিল্পাঞ্চলের কয়েক জন তৃণমূল নেতা নিজেদের মতো করে যোগাযোগ করেছিলেন দলের একাধিক শীর্ষ নেতার সঙ্গে। আর্জি ছিল, যদি আড়ালে-আবডালেও কিছু কয়লা ‘চালানো’ যায়। সেই আবেদন দিনের আলো দেখেনি।

বুধুর বৌ বলছিলেন, “রাতভর কাজের পরে শুধু হেঁশেল ঠেলার সময়টুকু। তার পর ফের ছুট খাদানে। এমনও দিন গিয়েছে, হাজার টাকা তুলে দিয়েছি মরদের হাতে।” কথাটা যে খুব মিথ্যে নয়, তা মানছে পাচারকারীরাও। জামুড়িয়ার রাখালপুর গ্রামের এক কয়লা ব্যবসায়ীর কথায়, “দিন-রাত কাজ হলে একটা খাদান থেকে ২৪০-২৫০ ধামা (লোহার বাস্কেট) কয়লা উঠত। ধামা-পিছু মজুরি ছিল ৪০ টাকা। যদি ১০ জন মিলেও ওই কয়লা তুলত, তা হলে একেক জন হাজার টাকা বাড়ি নিয়ে যেত। পরিবারের লোক যত বাড়ত, আয়ও বাড়ত

পাল্লা দিয়ে।”

‘কালো’ টাকায় সচল এমন সংসারগুলো হঠাৎ আঁধার নেমে আসার বিষয়টাকে রাজনীতির তাগিদে কার্যত খুঁচিয়ে তুলছে সিপিএমই। প্রকাশ্যে, মিটিং-মিছিলে কয়লা নিয়ে রা না কাটলেও ঘরোয়া বৈঠকে গ্রামের লোকজনকে ডেকে স্থানীয় সিপিএম নেতারা বলছেন, “আমরা একটা খাদানও বন্ধ করিনি। কারও পেটে লাথি মারিনি। তোমরাই তো পরিবর্তন চেয়েছিলে।” বস্তুত, আসানসোলের নির্বাচনে ‘লাল যার, কালো তার’ এই স্লোগানকে সামনে রেখেই এত দিন ভোট টেনেছে সিপিএম। লালকে ভোট দিলে তবেই মিলবে কয়লার কারবার করার অধিকার, তৎকালীন শাসক দলের নিচুতলার নেতারা এই বার্তাই দিতেন গ্রামে গ্রামে। এ বারও শুধু সুরটা বদলে গিয়েছে।

তৃণমূলের কিন্তু উভয়সঙ্কট। এক দিকে কয়লা নিয়ে সিপিএমের চোরাগোপ্তা আক্রমণ, অন্য দিকে দলের মধ্যেই মাথাচাড়া দেওয়া নানা গোষ্ঠীর কার্যকলাপে কার্যত জেরবার আসানসোলের তৃণমূল। এই কেন্দ্র থেকেই শহরের ভূমিপুত্র, অধুনা রাজ্যের কৃষিমন্ত্রী মলয় ঘটক বার তিনেক লড়াই করেছেন লোকসভা ভোটে। কিন্তু প্রতি বারই জয় অধরা থেকে যাওয়ায় এ বার দলের শ্রমিক সংগঠনের নেত্রী দোলা সেনকে কলকাতা থেকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে আসানসোলে প্রার্থী করেছে তৃণমূল। এতে যে সেখানকার নিচুতলার কর্মীরা যারপরনাই কুপিত, সে কথা আড়ালে বলতে দ্বিধা করছেন না তাঁরা। বলছেন, “মলয়দা যখন লড়েছেন, তখন পুলিশ-প্রশাসন সবই ছিল সিপিএমের হাতে। জামুড়িয়া বা রানিগঞ্জের অধিকাংশ বুথে এজেন্টই দিতে পারতাম না আমরা।” এখন যখন সব এলাকা আমাদের দখলে, তখন মলয়দাকে টিকিট না-দেওয়া কি সুবিচার হল, প্রশ্ন উঠেছে তৃণমূলের অন্দরেই।

মলয়বাবু অবশ্য এ সব কথা গায়ে মাখছেন না। তাঁর বক্তব্য, “এগুলো কাগজের বানানো গল্প। আমরা সবাই হাতে হাত ধরে লড়াই করছি। আমাদের প্রার্থীই জিতবে।” মন্ত্রী বলছেন বটে এ কথা, কিন্তু ভোটের বাজারে বহিরাগত-কাঁটা কি সত্যিই উপড়ে ফেলতে পেরেছে তৃণমূল? যদি পারতই, তবে কেন বদ্ধ ঘরের কর্মিসভা কিংবা গ্রামেগঞ্জের জনসভায় আগে থেকেই স্থানীয় নেতাদের বলতে হচ্ছে, “আমাদের প্রার্থীকে বহিরাগত ভাববেন না। অনেক আগে থেকেই এখানকার শ্রমিক সংগঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি। সেই সুবাদে আসানসোল তাঁর এক রকম ঘরবাড়িই হয়ে গিয়েছে।” এতে কতটা চিঁড়ে ভিজবে, তা সময়ই বলবে। কিন্তু তার আগে দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ধামাচাপা দিতে যে যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছে, এ কথা মানছেন তৃণমূলের অনেক নেতাই।

দোলাদেবী বলছেন, “২০১১-র বিধানসভা নির্বাচন থেকে আসানসোলে আমাদের ভোট বাড়ছে। সাংগঠনিক হিসেবে, পঞ্চায়েতে আমরা এই লোকসভা কেন্দ্রে দু’লক্ষ ভোটে এগিয়ে ছিলাম। বলতে পারি, সংখ্যাটা আরও বাড়বে।” বিজেপিকে কি নম্বর দিচ্ছেন না? “একেবারেই না। ওদের প্রার্থীকে তো সংবাদমাধ্যমই তুলছে। গত বার এখানে বিজেপি যে ভোট পেয়েছিল, এ বার তা-ও পাবে না।”

তৃণমূল প্রার্থী এ কথা বললেও আসানসোলের গোটা ছবিটাই যে এ বার আলাদা, তা বুঝছেন তাঁর দলের অনেকেই। রাজনীতির লোকেরাই বলছেন, প্রথম দিকে বিজেপি প্রার্থী বাবুল সুপ্রিয়কে আর পাঁচ জন সেলেব্রিটির মতো ‘ভোটের পাখি’ ভেবেছিল তৃণমূল-সিপিএম। কিন্তু দিনের পর দিন মাটি কামড়ে পড়ে থেকে, একবারে রাস্তায় নেমে বিরোধীদের মুখোমুখি হয়ে দলের কর্মীদের যে ভাবে চাঙ্গা করে তুলেছেন বাবুল, দেরিতে হলেও সেই বিপদ আঁচ করেছেন অন্য দলের নেতারা। তাই দলীয় প্রচারে সিংহভাগ বিজেপির পিছনেই ব্যয় করছে তৃণমূল।

রেহাই নেই খোদ প্রার্থীরও। জাতীয় সড়ক অবরোধ থেকে অস্ত্র আইন, ইতিমধ্যে একাধিক মামলা দায়ের হয়েছে বাবুলের বিরুদ্ধে। প্রথমটিতে আদালতে জামিন পেলেও ঝুলে আছে জামিন-অযোগ্য দ্বিতীয় মামলাটি।

একেবারে পোড়খাওয়া রাজনীতিকের মতোই সে সব সামলাচ্ছেন সুপ্রিয় বড়াল। তাঁর বক্তব্য, “ওরা যত এ সব করবে, তত সাধারণ মানুষ আমার সমর্থনে এগিয়ে আসবে। তারই প্রতিফলন মিলবে ভোটের বাক্সে।” মোদী হাওয়ায় ভর করে তিনি নিজের মতো পাল তুলেছেন আসানসোলে। এই গনগনে রোদে পা পুড়ে যাওয়া মাটিতে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্যের সাক্ষী হতে চাইছেন বহু মানুষ। আর সেই প্রচারের আকর্ষণ অবশ্যই টুকরো টুকরো গানের কলি। কোথাও আদুড় গায়ে কিশোর, কোথাও বন্ধ কারখানার মজুর, কখনও বা আসানসোল কোর্টের আইনজীবীদের আর্জি মেটাতে হচ্ছে চেনা-অচেনা গান শুনিয়ে।

এরই মধ্যে ভোট কাড়তে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছেন বছর একত্রিশের আইনের স্নাতক, কংগ্রেস প্রার্থী ইন্দ্রাণী মিশ্র। এক সময় এই লোকসভার বারাবনি, হীরাপুর কিংবা আসানসোল কেন্দ্র থেকে বিধানসভায় জিতেছিল কংগ্রেস। সেই সুদিন ক্রমে বিবর্ণ হলেও ইন্দ্রাণীর বিশ্বাস, কংগ্রেস তার পুরনো জমি ফেরত পাবে।

সব শুনে মুচকি হেসেছেন আসানসোলের দু’বারের সাংসদ সিপিএমের বংশগোপাল চৌধুরী। কেবল বলেছেন, “এলাকাটাকে আমি কিন্তু হাতের তালুর মতো চিনি।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

election in asansol debjit bhattacharya
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE