Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

খেলার মাঠ থেকে নাট্যমঞ্চ, অবহেলায় সবই

শহর বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে উৎকর্ষতা লাভ করেছিল শিক্ষা-সংস্কৃতি-ক্রীড়া। নাটক চলত বছরভর। ফুটবল মাঠে নানা রকম প্রতিযোগিতা। শহরের কলেজে বাইরে থেকে পড়তে আসতেন বহু ছাত্রছাত্রী। কিন্তু শহরের অর্থনীতিতে ভাটার টান পড়ার পরে ফিকে হয়েছে সে সব ঐতিহ্যও।

বেহাল রানিগঞ্জ রবিন সেন স্টেডিয়াম ও সিহারশোল মঞ্চ। —নিজস্ব চিত্র।

বেহাল রানিগঞ্জ রবিন সেন স্টেডিয়াম ও সিহারশোল মঞ্চ। —নিজস্ব চিত্র।

নীলোৎপল রায়চৌধুরী
রানিগঞ্জ শেষ আপডেট: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০১:৫১
Share: Save:

শহর বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে উৎকর্ষতা লাভ করেছিল শিক্ষা-সংস্কৃতি-ক্রীড়া। নাটক চলত বছরভর। ফুটবল মাঠে নানা রকম প্রতিযোগিতা। শহরের কলেজে বাইরে থেকে পড়তে আসতেন বহু ছাত্রছাত্রী। কিন্তু শহরের অর্থনীতিতে ভাটার টান পড়ার পরে ফিকে হয়েছে সে সব ঐতিহ্যও।

রানিগঞ্জ সিহারশোল রাজবাড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতেন কাজী নজরুল ইসলাম। শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় পড়াশোনা করেছেন রানিগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে। তাঁদের দু’জনের মধ্যে বন্ধুত্বের কথা শৈলজানন্দের লেখাতেও পাওয়া যায়। তাঁরা যে শ্মশান কালীবাড়িতে আড্ডা দিতেন, সেখানে এখন আর শ্মশান নেই। সিহারশোলের নিবারণ ঘটকের হাত ধরে স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে বিপ্লবী সংগঠনও গড়ে উঠেছিল।

সিহারশোলের বাসিন্দারা ১৯১৩ সালে প্রথম ‘সিন্ধুবধ’ নাটক পরিবেশন করেন। এই খনি শহরে নাট্যচর্চার সেটাই সূচনা বলে ধরা যায়। ওই গ্রামকেও বলা হয় ‘নাটকের গ্রাম’। সিহারশোলের বাসিন্দা, রানিগঞ্জ গার্লস কলেজের কর্মী ফাল্গুনী চট্টোপাধায়ের কথায়, “বয়স ত্রিশ পেরিয়েছে, অথচ নাটকে অভিনয় করনেনি, এই গ্রামে এমন কারও দেখা পাওয়া ভার।” গ্রামবাসীরা এই নাটক শুরু করেছিলেন কাঠের মঞ্চ তৈরি করে। পরে সেই জায়গায় জমিদার বাড়ির তরফে স্থায়ী মঞ্চ তৈরি করে দেওয়া হয়। সেই মঞ্চও ভেঙে পড়ার পরে ‘সিহারশোল স্পোটর্স অ্যান্ড কালচারাল অ্যাসোসিয়েশন’ ১৯৯৫ সালে সংগঠনের সুবর্ণ জয়ন্তী মঞ্চ নির্মাণ করে। এই সংগঠনের জন্ম ১৯৪৬ সালে। তখন থেকে তারা বাৎসরিক নাট্যোৎসবের আয়োজন শুরু হয়। জমিদার বাড়ি অল্প সময়েই নাট্যচর্চার পৃষ্ঠপোষক হয়ে ওঠে। জমিদার পশুপতি মালিয়া নিজেও নাটকে অভিনয় করেছেন। শোনা যায়, মাইকেল মধুসূদন দত্ত সিহারশোল জমিদারবাড়িতে নানা সাংস্কৃতিক আসরে যোগ দিতে আসতেন।

প্রাক্তন অধ্যক্ষ রামদুলাল বসুর খেদ, রানিগঞ্জের কোনও নাটকের দল বাইরে থেকে পুরস্কার নিয়ে এসেছে, ইদানীং তা আর তেমন শোনা যায় না। সিহারশোলেও নাটকের চর্চার সেই রমরমা এখন অতীত। বঙ্গভবনে ১ বৈশাখ থেকে শুরু করে বছরভর যে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড চলত, তা এখন আর হয় না। নানা ঘরোয়া অনুষ্ঠানে এখন তা ভাড়া দেওয়া হয়।

শহরের আইনজীবী গোপাল নন্দ বলেন, “যে মৃত্যুঞ্জয় ইনস্টিটিউট এক সময়ে নানা সাংস্কৃতিক কাজকর্ম করত, এক সময়ে কাজী নজরুল ইসলামকে সংবর্ধনা দিয়েছিল, এখন তাদের কার্যত কোনও কর্মকাণ্ড নেই!” ‘মালিয়া হেরিটেজ সোসাইটি’র সদস্যা অনুরাধা মালিয়া বলেন, “শহরের প্রাচীন ঐতিহ্য ফরিয়ে আনতে আমরা এই সোসাইটি তৈরি করেছি সাড়ে চার বছর আগে। প্রথম বছর আমরা জমিদার বাড়িতে কবি সম্মেলনের আয়োজন করি। ২০১২ সালে আমাকে বইমেলা কমিটির আহ্বায়ক করা হয়।” তাঁর দাবি, “সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ কী ভাবে সমস্যা তৈরি করছে, তা তখনই বুঝতে পারি।”

১৯৫৭ সালে রানিগঞ্জে ত্রিবেণীদেবী ভলোটিয়ার দান করা জমিতে কলেজ গড়ে ওঠে। তার আগে এই শহরে উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান বলতে ছিল মাইনিং কলেজ। রানিগঞ্জ যখন মহকুমা শহর ছিল তখন আশপাশের এলাকা থেকে পড়াশোনার জন্যও অনেকে এখানে আসতেন। পরে আসানসোল মহকুমা হওয়ার পরে রানিগঞ্জ তার অধীনে যায়। ১৯৮০ সালে রানিগঞ্জ গার্লস কলেজ তৈরি হওয়া ছাড়া উচ্চশিক্ষার আর বিশেষ কোনও ক্ষেত্র এই শহরে গড়ে ওঠেনি। দুর্গাপুরে বা আসানসোলে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যে ভাবে নানা রকম শিক্ষার সুযোগ তৈরি হয়েছে, এই শহরের ক্ষেত্রে তা হয়নি বলে শহরবাসীর খেদ।

একই পরিস্থিতি ক্রীড়াক্ষেত্রেও। পুরসভা নিয়ন্ত্রিত রবিন সেন স্টেডিয়াম ও কলেজ মাঠ ছাডা প্রায় সব মাঠেই জল জমার সমস্যায় নিয়মিত খেলাধুলো চালানো মুশকিল। এক ক্লাবের কর্তা মলয় রায় জানান, রাজবাড়ি মাঠে খেলা ছাড়াও সারা বছর নানা অনুষ্ঠান হয়। অথচ, বিভিন্ন সময়ে এই রানিগঞ্জের বিজয় মান্ডি, বিদেশ সিংহ, রাখাল দাসদের মতো অনেকে কলকাতা ময়দানে খেলেছেন।

মলয়বাবু বলেন, “এখানে ক্রিকেট ও ফুটবলের একটি করে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে। প্রতিভার অভাব নেই। কিন্তু সরকারি তরফে কিছু সহযোগিতা প্রয়োজন। তা হলেই আবার আগের রমরমা ফিরে আসবে।” রানিগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বাসুদেব মণ্ডলও বলছেন, “সংস্কৃতির গতি রোধ হয়নি। একটু শ্লথ হয়েছে মাত্র। শুধু একটু উদ্যোগ দরকার।”

আশায় রয়েছেন রানিগঞ্জবাসী।

কেমন লাগছে আমার শহর? নিজের শহর নিয়ে আরও কিছু

বলার থাকলে district@abp.in-এ মেল পাঠান।

Subject-এ লিখুন ‘আমার শহর-রানিগঞ্জ’।

অথবা চিঠি পাঠান: ‘আমার শহর’, বর্ধমান বিভাগ,

জেলা দফতর, আনন্দবাজার পত্রিকা,

৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা- ৭০০০০১

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

nilotpal roychowdhury raniganj negligence
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE