হস্তশিল্প মেলায় পটচিত্র আঁকতে ব্যস্ত রবিউল। নিজস্ব চিত্র।
থিকথিকে ভিড়। তার মধ্যেই মাঠের এক কোনে আলো আঁধারিতে মাথা নিচু করে বসে রয়েছে বছর দশেকের ছেলেটি। কাছে গিয়ে দেখা যায়, বাবার পাশে বসে এক মনে মাটির পাত্রে ছবি আঁকছে। সূক্ষ নকশা, রঙের মিলমিশে পটের নানা ছবি ফুটে উঠছে তার হাতের ছোঁয়ায়।
রাজ্য হস্তশিল্প মেলায় আসরে এ বার নজর কেড়েছে পূর্ব মেদিনীপুরের চণ্ডীপুরের এই রবিউল। ছয় হোক বা ষাট, তার তুলির টান দেখতে ভিড় করছেন সকলে। রবিউলের অবশ্য তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই। কাজ করতে করতেই পঞ্চম শ্রেণির ওই পড়ুয়া বলে, ‘‘ ছবি আঁকতে খুব ভাল লাগে। বাড়িতেও পটের উপর ছবি আঁকি। মা-বাবার সঙ্গে মেলাতেও যাই।’’
রাজ্য ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প দফতরের উদ্যোগে বাঁকা নদীর ধারে উৎসব ময়দানে বেশ কয়েক দিন ধরেই চলছে রাজ্য হস্তশিল্প মেলা। শ’পাঁচেক শিল্পী হাতের কাজের পসরা নিয়ে মাঠ সাজিয়েছেন। নানা নদীর নামে প্রত্যেক জেলারও আলাদা বিপণি রয়েছে। যেমন, বর্ধমানের বিপণির নাম অজয়, দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার বিপণি মাতলা, জলপাইগুড়িটির নাম তিস্তা-তোর্সা। আবার কলকাতার দোকানটি পরিচিতি কল্লোলিনী নামে। রাজ্যের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প মন্ত্রী স্বপন দেবনাথের কথায়, ‘‘প্রত্যেক জেলার স্বতন্ত্র পরিচয় বজায় রাখতে সেখানকার নদ-নদীর নামে দোকান হয়েছে।’’ ৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলা মেলায় গত বারের চেয়ে বিক্রি বাড়বে বলেও মন্ত্রীর আশা।
মেলার মাঠে বর্ধমানের স্টলের উল্টো দিকেই বসছে রবিউল। প্রায় সারা দিনই পটচিত্র আঁকতে দেখা যাচ্ছে তাকে। ছেলের পাশে বসে বাবা বাবু চিত্রকর বলেন, ‘‘ছেলে আমার খুব দ্রুত মাটির পাত্রে স্কেচ করতে পারে। পড়াশুনোর পাশাপাশি হাতের কাজটাও শিখে রাখছে। ভবিষ্যতে সুবিধেই হবে।’’ মা রহিমা বিবিও জানান, পাঁচ বছর বয়েস থেকেই শুধু পটে নয়, মাটির পত্রে, আর্ট পেপারে ছবি আঁকে রবিউল। বিভিন্ন মেলায় ছেলের আঁকা ছবি সগর্বে বিক্রিও করেন তাঁরা। এমনকী, ছেলের আঁকা ছবি বিক্রি করে সংসারের হাল কিছুটা ফিরেছে বলেও তাঁর দাবি।
ওই দম্পতির কাছ থেকেই জানা যায়, রবিউলের মতো নতুন প্রজন্মের অনেকেই ফের পটচিত্রে আগ্রহ দেখাতে শুরু করেছে। তাদের হাত ধরেই পটের ছবি আরও অনেক পথ পাড়ি দেবে বলেও তাঁদের আশা। তাঁরা জানান, নানকার চকগ্রামে এখন প্রায় ৯০টি পরিবার এই কাজ করে। অথচ কয়েক বছর আগেও অনেকেই অন্য জীবিকার সন্ধানে নেমেছিলেন।
পথ বদলের কারণ কী? বাবু চিত্রকরের দাবি, ‘‘এখন স্বনির্ভর গোষ্ঠী গড়ে ব্যাঙ্ক থেকে সহজেই ঋণ পাওয়া যায়। আমরা দু’দফায় ঋণ নিয়ে চুড়িদার, টি-শার্ট, কাপড় কিনি। তার উপর ছবি এঁকে কলকাতা-সহ বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করি।’’ পটের ছবি আঁকা জামাকাপড়ের একটা বাজার তৈরি হয়ে গিয়েছে বলেও তাঁর দাবি। মেলায় আসা আর এক শিল্পী খুকুরানিও বলেন, “বছরে চার বার সরকারি সহায়তায় মেলায় যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। দুর্গাপুরে স্থায়ী হাটও আছে। ফলে, আমাদের হাতের কাজ দেখানোর বেশ কিছু সুযোগ তৈরি হয়েছে। কাজের কদরও বেড়েছে।’’
তবে এত আশার মধ্যে কাঁটাও যে খচখচ করছে না তা নয়। অনেক পট-চিত্রকরেরই দাবি, মেলায় যাতায়াত ও দৈনিক রাহা খরচ আগাম পাওয়া গেলে উপকার হতো। খুদে শিল্পীদের জন্য প্রশিক্ষণ শিবিরের ব্যবস্থা করারও আর্জি জানান তাঁরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy