Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

বিয়ে-অসুখের বাধা পেরিয়ে লড়াই মারুফার

বাড়িতে নিত্য অনটন। অবস্থা সামাল দিতে বাড়ির কন্যা সন্তানটির বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন বাবা। কিন্তু পড়াশোনা চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার অদম্য জেদ নিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিল স্নায়ুর রোগে ভোগা সেই মেয়ে। সেই জেদেই এ বারের মাধ্যমিকে কালনার গোয়াড়া এলাকার বাসিন্দা, মারুফা খাতুন ৮৪ শতাংশ নম্বর পেয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছে সকলকে।

মারুফা খাতুন।—নিজস্ব চিত্র।

মারুফা খাতুন।—নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কালনা শেষ আপডেট: ২৮ মে ২০১৫ ০০:১১
Share: Save:

বাড়িতে নিত্য অনটন। অবস্থা সামাল দিতে বাড়ির কন্যা সন্তানটির বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন বাবা। কিন্তু পড়াশোনা চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার অদম্য জেদ নিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিল স্নায়ুর রোগে ভোগা সেই মেয়ে। সেই জেদেই এ বারের মাধ্যমিকে কালনার গোয়াড়া এলাকার বাসিন্দা, মারুফা খাতুন ৮৪ শতাংশ নম্বর পেয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছে সকলকে।

পড়শিরা জানান, হাটকালনা পঞ্চায়েতের ওই এলাকার বহু পরিবারই আর্থিক অনটনের কারণে অল্প বয়স থেকেই মেয়েদের বিয়ের তোড়জোড় শুরু করেন। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা যথেষ্ট সেখানে। মারুফার বাড়ির লোকজনও সেইমতো বিয়ের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। কিন্তু ছিপছিপে মেয়েটি বেঁকে বসে জানিয়ে দেয়, সে পড়াশোনা চালিয়ে নিয়ে যেতে চায়। মারুফার মনের জোর দেখে এগিয়ে আসেন তাঁর স্কুল কৃষ্ণদেবপুর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা এবং স্থানীয় কয়েকজন শিক্ষক। শুরু হয় দিন-রাতের যুদ্ধ। মারুফা বলে, ‘‘বাবা-মা কেউই প্রাথমিকের গণ্ডী পেরোননি। ফলে পড়াশোনায় তেমন সাহায্য করতে পারেননি। আমার শরীরও ভাল থাকত না। এ অবস্থায় পাঠ্য বই আর শিক্ষকেরাই ভরসা ছিলেন।’’

মারুফার বাবা ইয়াসিন শেখ পেশায় রাজমিস্ত্রী। বছরভর কাজ না মেলায় মারুফের মা মমতাজ বিবিও বিড়ি বাঁধেন। অশক্ত শরীর নিয়ে ঠাকুমা রহিমা বিবিকেও নিয়মিত চরকা ঘুরিয়ে সুতো কাটতে হয়। ২০০৮-২০০৯ আর্থিক বছরে স্থানীয় পঞ্চায়েতের করফে পরিবারটিকে ইন্দিরা আবাসন প্রকল্পে একটি ঘর করে দেওয়া হয়। মারুফা জানায়, অর্থ কষ্টের জেরে মাধ্যমিকের প্রয়োজনীয় সব বইও হাতে পায়নি সে। ছিল না তেমন কোনও রেফারেন্স বইয়ের জোগানও। এর সঙ্গে যুক্ত হয় শারীরিক অসুস্থতা। মাঝেসাঝেই স্নায়ুর রোগে ভোগা মারুফা পরীক্ষার আগেও বেশ কয়েকবার অসুস্থ হয়ে পড়ে। শুধুমাত্র স্কুলের মাস্টারমশাইদের উপর ভরসা করেই পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছে মারুফা। মাধ্যমিকের আগে স্থানীয় গজলক্ষ্মী বিদ্যালয়ের শিক্ষক জয়ন্ত দেবনাথ মারুফাকে পড়াশোনায় বিভিন্নভাবে সাহায্য করেছেন। জয়ন্তবাবু বলেন, ‘‘মারুফা অত্যন্ত মেধাবী। একটু সাহায্য পেলেই ও আরও অনেক দূর এগোবে। ওর বাবাকেও মেয়ের পড়াশোনা চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য রাজি করানো গিয়েছে।’’

তবে মেয়ের ফল দেখে বাবা ইয়াসিনের চোখে খুশি থাকলেও আগে পড়ানোর চিন্তাটাই বেশি। তাঁর আশঙ্কা, ‘‘সংসার চালানোর মতোও আয় নেই আমাদের। এই পরিস্থিতিতে কী ভাবে মেয়ের উচ্চশিক্ষার খরচ চালাব তা বুঝে উঠতে পারছি না। কেউ যদি মেয়েকে একটু সাহায্য করেন ভীষণ ভাল হয়।’’ ৬টি বিষয়ে লেটার নম্বর পাওয়া মারুফা ভবিষ্যতে শিক্ষক হতে চায়। কিন্তু টাকার টানাটানিতে এখন মারুফাও যেন খানিকটা হতাশ। ছলছল চোখে বলে ওঠে, ‘‘জানি না কীভাবে স্বপ্ন সত্যি হবে।’’

কিন্তু পর মুহূর্তেই হতাশা ঝেড়ে ফেলে উচ্চ মাধ্যমিকের প্রস্তুতি শুরু করা মারুফাকে দেখে মনে হয়, এত সহজে হেরে যাওয়ার পাত্রী নয় সে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE