ঠাকুর দেখতে এসে ছবি তোলা। নিজস্ব চিত্র।
মণ্ডপে ঢোকার মুখে সিঁড়িতে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল কিশোরীর দল। কোনও এক জন প্রস্তাব পেড়েছে, ‘এখানে একটা ছবি হোক’। সঙ্গে সঙ্গে একে অপরের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়া। আশ মিটিয়ে নিজস্বী তুলে বীণাপাণি-দর্শনে গেল তারা।
পরনে জিন্সের উপরে রঙিন জ্যাকেট। কারও মাথায় কেতাদুরস্ত টুপি। কারও চোখে আবার রোদ-চশমা। ঝকমকে পুজো প্যান্ডেলের পাশে নানা ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে সদ্য গোঁফ ওঠা কিশোরেরা। মোবাইলে ছবি তুলে দিচ্ছে কোনও বন্ধু। খানিকক্ষণের মধ্যে সেই ছবি পৌঁছে গেল সোশ্যাল নেটওয়ার্কিস সাইটেও। নতুন পোশাকে তাকে কেমন লাগছে, সেই প্রশ্নও সেখানে রেখে দিল বন্ধুদের জন্য।
অনভ্যস্ত হাতে শাড়ি সামলাতে সামলাতে ছাত্রীদের ঢল রাস্তায়। আলুকাবলি, ফুচকা, চাউমিনের দোকানের সামনে ছোট ছোট জটলা। আড়চোখে দেখে নেওয়া সামান্য দূরে দাঁড়ানো দলটিতে কে কেমন সেজেছে। শনিবার সকাল থেকে রবিবার সন্ধে। কালনার বিভিন্ন মণ্ডপের সামনে দেখা গেল এমনই নানা ছবি।
ভাগীরথীর ধারে প্রাচীন এই কালনা শহরে সরস্বতী পুজোর ইতিহাস বেশ পুরনো। কথিত রয়েছে, এক সময়ে বহু পণ্ডিত বিদ্যাচর্চার টোল চালাতেন এই এলাকায়। সেই সূত্রেই বিদ্যার দেবীর পুজো শুরু হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পুজোকে ঘিরে আড়ম্বর ও উন্মাদনা বেড়েছে। দুর্গাপুজো-কালীপুজোর পরে সরস্বতী-আরাধনাতেও ঢুকে পড়েছে থিমের চল। এ বার কালনা শহর ও তার আশপাশে প্রশাসন অনুমোদিত পুজোর সংখ্যা শ’দেড়েক। এর মধ্যে গোটা পঞ্চাশ পুজো মণ্ডপ তৈরি হয়েছে নানা শিল্পকর্মের নিদর্শন রেখে। স্থানীয় সূত্রের খবর, মহকুমা জুড়ে অনুমতি না নেওয়া ছোট-বড় পুজোর সংখ্যা অন্তত সাতশো।
কালনা ও লাগোয়া এলাকায় শুক্রবার থেকেই উৎসব শুরু হয়ে গিয়েছে। ক্লাবগুলি তাদের মণ্ডপ সাজিয়ে তুলেছিল তার মধ্যেই। পছন্দ করে হাল ফ্যাশনের পোশাক, শাড়ির রঙের সঙ্গে সাজুয্য রেখে গলার হার বা কানের দুল কেনা এ সবের হিড়িকে শহরের দোকানগুলিও ছিল জমজমাট। চুলে পছন্দসই ছাঁট দেওয়ার জন্য লম্বা লাইন ছিল সেলুনের সামনেও। কিছু উদ্যোক্তা শনিবার পুজো করলেও বেশির ভাগেরই সেই আয়োজন ছিল রবিবার। বিভিন্ন স্কুলও এ দিনই খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করেছিল পড়ুয়াদের জন্য। তাই উৎসবের পরিবেশ জমে উঠেছিল এ দিনই।
শহরের এক শিক্ষিকা অনিন্দিতা কর্মকার বলেন, “প্রতি বছরই সবচেয়ে ভাল পোশাকটা তুলে রাখি সরস্বতী পুজোর সকালে পরার জন্য।” কালনার যুগেরদ্বীপ ক্লাবের মণ্ডপের সামনে দাঁড়িয়ে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী তনুশ্রী সরকার, কাকলী ভট্টাচার্যেরা বলে, “এই দিনটা আমাদের জন্য স্পেশ্যাল। স্কুলে খিচুড়ি খেয়েই আবার বেরিয়ে পড়েছি।” কলেজ ছাত্র রূপেশ দেবনাথ, অলীক চট্টোপাধ্যায়দের কথায়, “এ দিনটার জন্য তো এখানকার সব ছাত্রছাত্রীরা তৈরি হয়!”
শহরের সরস্বতী পুজোর কথা উঠতে স্মৃতিমেদুর হয়ে পড়েন বছর সত্তরের পরিতোষ পাত্র। তিনি বলেন, “আমাদের সময়ে অনেকেই সরস্বতী পুজোর সময়ে চিরকুট আর চিঠি পাঠিয়ে প্রেমের প্রস্তাব দিত। সময় বদলেছে। এখন তো মোবাইলই সব।” শহরের বাসিন্দা সুরঞ্জনা ঘোষের মেয়ে স্কুলে পড়েন। সহপাঠীদের সঙ্গে সে বেরিয়ে পড়েছে ঠাকুর দেখতে। সুরঞ্জনাদেবী বলেন, “ওরা ওদের মতো করে আনন্দ উপভোগ করছে। এতে আপত্তি বা শঙ্কার কিছু দেখি না।”
মাইকে গান বেজে চলেছে অবিরাম। মণ্ডপে সারি-সারি আলো। নানা রকম কারুকাজ। তার ফাঁকে নিজস্বীতে মগ্ন লজ্জামাখা মুখ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy