বাঁ দিকে, বন্ধ ইসবপুরের বাজি কারখানা। ডান দিকে, আসানসোলে বিকোচ্ছে আলোর বাজি। —নিজস্ব চিত্র।
মাটির বাড়ির উঠোনে ছড়ানো রয়েছে তুবড়ির খোল। ইতিউতি পড়ে রয়েছে বারুদ, কয়লা, গন্ধক-সহ বাজি তৈরির নানা উপকরন। উঠোনের এক দিকে বসে মাটির তুবড়ির খোলে মশলা ভরছেন মহিলারা। পুরুষেরা কখনও তাঁদের সঙ্গে বাজি তৈরিতে হাত মেলাচ্ছেন, কখনও বাড়ির বাইরে সতর্ক দৃষ্টি রাখছেন।
কারখানার কাছে অপরিচিত কোনও খরিদ্দার এসে বাজির খোঁজ করলেই প্রস্তুতকারকেরা সটান বলে দিচ্ছেন, এ বার তারা ‘মাল’ তৈরি করেননি। কেউ কেউ আবার মেমারির গৌরীপুর এলাকার কয়েকজন প্রস্তুতকারকদের ঠিকানা দিয়ে ভাগিয়ে দিচ্ছেন ক্রেতাদের। এক কথায়, পুলিশের ধরপাকড় আর নজরদারির আতঙ্কে এ বার কালীপুজো স্থানীয় শিল্পীদের হাতে তৈরি অনেক বাজিই মিলছে না। আর এ নিয়ে আক্ষেপের শেষ নেই পুজো উদ্যোক্তাদের।
কালনার ইসবপুর, বটতলা, আনুখাল, কাদিপাড়া-সহ কয়েকটি গ্রাম জুড়ে বাজি তৈরির কারবারের কথা বহু পুরনো। স্থানীয়রা জানান, দুর্গাপুজোর মাসখানেক আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় বাজি তৈরি। হরেক রকমের আতসবাজি তৈরিতে দক্ষ ওই এলাকার বাসিন্দারা। সারা বর্ধমান জেলায় তো বটেই জেলার বাইরেও যায় এখানকার তৈরি বাজি। তবে সব থেকে বেশি বাজি বিক্রি হয় কালীপুজোয়। কিন্তু এ বার ওই এলাকায় ঢুঁ মেরে দেখা গিয়েছে অন্যান্য বছরের তুলনায় বেশ চুপচাপ গ্রামগুলি। কেন?
গত বছর কালনা ২ ব্লকের একটি গ্রামে বাড়িতে কালীপুজোর আগে শব্দবাজি বানানোর সময়ে আগুন লেগে গিয়েছিল। সেই দুর্ঘটনায় প্রাণ গিয়েছিল এক দম্পত্তির। এর পর থেকেই শব্দবাজি আটকানোর জন্য শুরু হয়েছিল পুলিশি ধরপাকড়। তল্লাশি চালিয়ে দু’ট্রাক অবৈধ বাজিও আটক করে দমকল। কয়েক জনকে গ্রেফতার করা হয়। এ বছরও দুর্গাপুজোর আগে থেকে চলছে লাগাতার অভিযান। এ বছর নতুন করে কাউকে বাজি তৈরির অনুমোদন দেয়নি মহকুমা প্রশাসন। তাই এ বার বাজি প্রস্তুতকারকরা অনেকটাই সতর্ক। শুধু শব্দবাজিই নয়, লাগাম রয়েছে আতসবাজি তৈরিতেও। বাজি ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, পুলিশি হয়রানির কারণে অনেকেই এ বার বাজি তৈরি করেননি। এরকমই একজন বাজি ব্যবসায়ী কালো শেখ। তিনি বলেন, “গত বছর বাজি কারখানায় বিস্ফোরণের পর আমার ছোট ছেলেকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। এ বার সরকারি ভাবে লাইসেন্স নবীকরণ হয়নি। তাই বাজির কারখানা বন্ধ করে দিয়েছি। যাঁরা বাজির খোঁজে আসছেন তাঁদের ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছি।” তবে ভিন্ন সুরও রয়েছে। বাজি ব্যবসায়ীদের একাংশের খেদ, মুনাফার লোভে নিরাপত্তার কথা না ভেবেই বিপদ ডেকে আনা হয়েছে।
কালনায় তৈরি অন্যতম সেরা বাজি হল গাছ বাজি। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, এই বাজির আলো প্রায় ১০-১২ ফুট উচ্চতা পর্যন্ত উঠতে পারে। এ ছাড়া তুবড়ি, হাউই, চরকি-র তো রয়েইছে। খোলা বাজারে যে আতসবাজি মেলে তার থেকে বাজি কারখানা থেকে কেনা আতসবাজির স্থায়িত্ব বেশি থাকে। কিন্তু এ বার বাজির সরবরাহ কমে যাওয়ায় উদ্যোক্তারাও চিন্তিত। এলাকার একটি কালীপুজোর উদ্যোক্তা হরিলাল সাহা বলেন, “বাজি ছাড়া দীপাবলি বেমানান। আর গাছ বাজির মত বাজির তো জুড়ি মেলা ভার। কিন্তু এ বার এই বাজি মিলবে কী না সংশয় রয়েছে।” অপর পুজো উদ্যোক্তা রমেশ ঘোষ বলেন, “বিসর্জনের রাতে বাজি ছাড়া আনন্দ হয় না। শুনছি এ বার অনেক বাজিই মিলছে না। চিন্তায় রয়েছি।”
তবে মহকুমা পুলিশের এক কর্তা সাফ জানান, শুধু গত বছরই নয়। এর আগেও বিভিন্ন সময় বাজি কারখানায় বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। তাই এ ব্যাপারে কোনও শিথিলতা বরদাস্ত করা হবে না। কালনার মহকুমাশাসক সব্যসাচী ঘোষ বলেন, “কালনার বাজি প্রস্তুতকারকদের অনেকেরই প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো নেই। ফলে এ বার নতুন করে কাউকে অনুমোদন দেওয়া হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে লাইন্সেস নবীকরণও করা হয়নি। আগামী বছর পরিস্থিতি দেখে বিষয়টি নিয়ে ভাবনা চিন্তা করা হবে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy