ভোটের চিঠি পেয়েই মনে প়ড়ছিল মাস পাঁচেক আগেকার অভিজ্ঞতা। পুরভোটে দায়িত্ব পেয়ে বুথে গিয়ে জুটেছিল ঠান্ডা গলার হুমকি। ফিরে আসছিল সেই স্মৃতিই।
দায়িত্ব পড়েছিল পাণ্ডবেশ্বর বিধানসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত মেটাল ধাওড়া গ্রামের বুথে। ভোটের আগের দিন ভোটের সামগ্রী বিতরণ কেন্দ্র (ডিসিআরসি) থেকে সামগ্রী সংগ্রহ করার পরে গন্তব্যে পৌঁছনোর বাসের খোঁজ শুরু হল। চারপাশে তখন লু বইছে। ঘণ্টা দেড়েক বাসযাত্রার শেষে পৌঁছলাম অজয়ের পাড়ে ওই গ্রামে। সেখানে একটি শিশু শিক্ষাকেন্দ্রে বুথ। আসার আগে শুনেছিলাম, গ্রামে বেশ কয়েক বার নাকি গোলমালের ঘটনা ঘটেছে। সে জন্য মনের কোনে কোথায় যেন একটু আতঙ্ক লুকিয়ে ছিল। কিন্তু বুথে পৌঁছে কেন্দ্রীয় বাহিনীর জনা চারেক জওয়ানকে দেখে বুকে বল এল।
তবে শুরু হল অন্য এক সমস্যা। জল মিলছে না কোথাও। খোঁজ নিয়ে জানলাম, শ’দেড়েক পরিবার গ্রামে বাস করে। ভরসা ৬টি কুয়ো। তার পাঁচটিতেই জল নেই। স্কুল চত্বরের একটি কুয়োতেও জল তলানিতে ঠেকেছে। সেক্টর অফিস থেকে থেকে জলের ব্যবস্থা করা হবে বলে প্রশাসনের তরফে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কোথায় কী! চার জন ভোটকর্মী, ভিডিওগ্রাফার, কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ান, রাজ্য পুলিশের কর্মী সমেত আমরা মোট ১০ জন। জল কোথা থেকে মিলবে, তা নিয়ে সকলেই বেশ চিন্তায় পড়ে গেলাম। খানিক পরে দেখি, গ্রামের মহিলারা জল নিয়ে আসছেন। তাঁরা জানালেন, অজয়ের চরে বালি খুঁড়ে মিলেছে এই জল। শেষমেশ জল কিনে খাওয়ার একটা ব্যবস্থা হল। প্রাণ ফিরল ধড়ে।
দিনভর ধুলো আর চড়া গরমে কেটেছে। স্নান করার চেষ্টা করতেই আবার সমস্যা। শিক্ষাকেন্দ্রের দু’টি শৌচাগারই বেহাল পড়ে। অপরিষ্কার শৌচাগার দু’টির কোনওটিই ব্যবহারের উপযুক্ত নয়। গ্রামেরই এক জনের কাছে দড়ি-বালতি জোগাড় করা হল। কুয়ো থেকে জল তুলে গা-মুখ ধুয়ে নিলাম। ভোটকেন্দ্রে ঢোকার আগেই গ্রামের কয়েক জন বলছিলেন, ‘‘সাবধানে থাকবেন, ওখানে কিন্তু সাপ আছে।’’ বুথে পৌঁছে চারপাশে ঝোপ-জঙ্গল দেখে ভয়টা জাঁকিয়ে বসল। চারদিকে কার্বলিক অ্যাসিডও ছড়ানো হল। কিন্তু ভয় যে পিছু ছাড়ে না কিছুতেই। রাতে মেঝেতেই খানিক ঘুমিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা হল।
গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেল। ভাবলাম একটু বাইরে গিয়ে হাওয়া খাওয়া যাক। বাইরে বেরোতেই দেখি, জওয়ানেরা কড়া নজর রেখেছেন। শিক্ষাকেন্দ্রের গেট আগলে দাঁড়িয়ে আছেন দু’জন। এক জন টহল দিচ্ছেন সামনের রাস্তায়। আর এক জওয়ান ছাদের মাথায় উঠে ক্রমাগত সার্চলাইট ফেলে চলেছেন চার দিকে। খেয়াল করলাম, সার্চলাইটের মুখটা বেশির ভাগ সময়েই অজয়ের দিকে রয়েছে।
পরের দিন সকাল থেকে রীতিমতো উৎসবের মেজাজে ভোট শুরু হয়ে গেল। বাসিন্দাদের ভোট দেওয়ার উৎসাহ দেখে কেটে গেল সমস্ত উদ্বেগ, শঙ্কা।
(লেখক বার্নপুরের সুভাষপল্লি বিদ্যানিকেতনের শিক্ষক)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy