এই ঘাট থেকে ছাড়ত কার টেগোর অ্যান্ড কোম্পানির নৌকাগুলি। আজ সেই ঘাট নেই। জল নেই দামোদরেও। ছবি: ওমপ্রকাশ সিংহ
হেঁই সা’, ‘হেঁই সা’ শব্দে দাঁড় টেনে চলেছে মাঝি। ভরা শ্রাবণে সে শব্দ যেন দামোদরের বুকে ছড়িয়ে পড়ছে সুর হয়ে। নদে ভেসে চলেছে সারি-সারি নৌকা। রেলপথ স্থাপনের বহু আগে এটাই ছিল দামোদরের পরিচিত দৃশ্য, যার শুরু ‘গুরু’ রুপার্ট জোন্সের হাত ধরে।
১৮১৭ সালের ডিসেম্বর মাস। বর্ধমানের মহারানির কাছ থেকে পাওয়া ১৩৩ বিঘা জমির পাট্টা আর কোম্পানির ঘর থেকে বার্ষিক ৬% হারে সুদে পাওয়া ৪০,০০০ টাকা সম্বল করে রুপার্ট জোন্স কয়লা খনি খুলেছেন নুনিয়াজোড়ের কাছে। উত্তোলিত কয়লা পরিবহণের মাধ্যম হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছিলেন দামোদর নদকেই। সেখানে তখন ভেসে বেড়াত ছোটছোট ছাউনি যুক্ত যাত্রীবাহী নৌকা। জোন্স সাহেবের ভাষায় ‘বর্ধমান নৌকা’। বহন ক্ষমতা বড়জোর দুশো মণ (১ মণ= ৩৭.৩২ কেজি)। সেই সব নৌকা ভাড়া নিলেন তিনি। পাশাপাশি, নিজের চেষ্টায় ‘রামগড় শাল’ ও লোহা দিয়ে বানালেন প্রায় চার থেকে পাঁচশো মণ কয়লা বহনে সক্ষম ‘ক্যারেজ’ নৌকা। কোম্পানিকে লেখা কয়েকটি চিঠিতে কয়লা পরিবহণ নিয়ে তাঁর নিখুঁত পরিকল্পনার কথা জানা যায়। তাঁর মৃত্যুর পরে ১৮২৯ সালে ‘গ্লিনিংস ইন সায়েন্স’ পত্রিকার প্রথম খণ্ডে এই চিঠিগুলি প্রকাশিত হয়েছিল।
এর পরে সময় যত গড়িয়েছে, কয়লার সঙ্গে তাল মিলিয়ে দামোদরের বুকে নৌকার সংখ্যা বেড়েছে। ১৮৩১ সালে আলেকজান্ডার কোম্পানির নৌকার সংখ্যা সাড়ে তিনশো। আরও পরে ‘বেঙ্গল কোল কোম্পানি’র আমলে সেই সংখ্যাটা প্রায় দেড় হাজারে ঠেকে। কয়লার পাশাপাশি, তখন এই নৌকা-নির্ভর পরিবহণ ব্যবস্থা এক স্বতন্ত্র শিল্পরূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। রানিগঞ্জের কয়লাখনিতে সেই সময়ে সেই সময়ে বেঙ্গল কোম্পানির কর্মিসংখ্যা ছিল পাঁচ হাজার আর কয়লার পরিবহণের সঙ্গে যুক্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ন’হাজার। এ তথ্য থেকেই বোঝা যায়, নদী-নির্ভর এই শিল্পের ব্যাপ্তি কতটা ছিল।
১৮৪০ সালে ‘কার টেগোর অ্যান্ড কোম্পানি’র ম্যানেজার সি বি টেলরের লেখা একটি চিঠি থেকে নদীকেন্দ্রিক এই পরিবহণ ব্যবস্থার একটি সুস্পষ্ট রূপরেখা পাওয়া যায়। তখন কয়লা উত্তোলনের পদ্ধতি ছিল আপাত সরল। সুড়ঙ্গের ভিতরে শাবল-গাঁইতি দিয়ে কাটা কয়লার বড় বড় চাঙড় কপিকলের সাহায্যে উপরে আনা হতো। প্রতি ঝুড়িতে আনুমানিক ছয় মণ করে কয়লা থাকত। উৎপাদন ব্যয় মণ প্রতি তিন পয়সা। প্রতি ঝুড়ি পিছু একটা নির্দিষ্ট টাকা শ্রমিকদের দেওয়া হতো মাইনে হিসেবে। খনি থেকে সে সব কয়লা মণ পিছু এক আনা দরে গরুর গাড়িতে চাপিয়ে জড়ো করা হতো নারানকুড়ি, দামালিয়া ঘাট সংলগ্ন এলাকায়।
দামোদর হয়ে দু’শো থেকে ছশো মণ কয়লা বোঝাই সেই সব নৌকা পাড়ি জমাত হাওড়ার আমতার দিকে। ভাড়া ছিল মণ প্রতি ন’পয়সা। সমস্ত কিছুর হিসেব মিলিয়ে এখানেই শেষ হতো টেলর সাহেবের কর্তব্য। বাকিটা বুঝে নিতেন আমতা ডিপোর ম্যানেজার মিস্টার মার্টিন।
এর পরে শ্রাবণ-ভাদ্র গড়িয়ে আসত আশ্বিন। বর্ষা শেষে দামোদরের যৌবন তখন বিগতপ্রায়। তার বুকে তখন উঁকি মারছে সাদা কাশের ঝাঁক। নদীঘাটেও তখন বার চারেকের ‘রাউন্ড’ সেরে ফিরে আসা নৌকার মিছিল। টেলর সাহেবের কাছে হিসেব বুঝে নিতে ব্যস্ত মাঝিরা। সঙ্গে আগামী বছরের অগ্রিম। এ বারে তাদের আমতা ফেরার পালা। তিন মাস ধরে সেখানে জড়ো করা কয়লা চার পয়সা প্রতি মণ দরে পৌঁছে দেবে কলকাতার কয়লাঘাটা ও খিদিরপুরের ডিপোতে।
তবে নদী-নির্ভর যাত্রাপথে সমস্যাও কিছু কম ছিল না। অপ্রতুল নাব্যতা দামোদরের চিরকালীন সমস্যা। কিন্তু বর্ষাকালে দামোদরের রূপ এক দম আলাদা। প্রবল বন্যা আর নৌকাডুবি ছিল যাত্রীদলের নিত্যসঙ্গী। ফি-বছর ভাড়া বৃদ্ধির দাবিতে মাঝিরা ধর্মঘট ডাকত। এরই সঙ্গে ছিল মাঝনদীতে কয়লা চুরির রমরমা। অনেক সময়ে কয়লার ভার বহনে অক্ষম নৌকা স্বেচ্ছায় নদীতে ফেলে দিত বাড়তি কয়লার বোঝা।
এ ভাবেই এগিয়ে চলতে থাকে সময়। টেলর, ওয়াটকিন্স, বিডল, — বদলে যেতে থাকেন নারানকুড়ির ঘাটের ম্যানেজারেরা। ‘কার টেগোর অ্যান্ড কোম্পানি’ নাম বদলে হয়ে যায় ‘বেঙ্গল কোল কোম্পানি’। নৌকা ও ডিঙির পাশাপাশি, এক সময়ে শুরু হল স্টিমারের যাতায়াত। সরকারি ও ব্যক্তিগত এই সব স্টিমারের জন্য প্রয়োজনীয় কয়লার বেশির ভাগটাই যেত রানিগঞ্জ থেকে। তবে শুধু কয়লা নয়, দামোদর দিয়ে সেই সময় নীল, রেশম, কাঠ প্রভৃতির পাশেই চলত চাল-নুন-তেলের মতো প্রয়োজনীয় জিনিসের আমদানি-রফতানি।
১৮৫৫ সালে রানিগঞ্জে এল রেল। শহর থেকে কয়লাখনি— বাষ্পীয় ইঞ্জিনের দ্রুতগতির ছাপ পড়ল সর্বত্র। অসম প্রতিযোগিতায় দামোদরের বুকে ভেসে থাকা নৌকা আর তার মাঝিরা ক্রমশ পিছিয়ে পড়তে থাকল। নদী আর নৌকাকে কেন্দ্র করে কয়েক দশক ধরে তিলে তিলে গড়ে ওঠা একটা অর্থনীতি এ ভাবে এক সময় লুপ্ত হয়ে গেল। নদীঘাটগুলি পড়ে রইল অতীত গৌরবের সাক্ষী হয়ে।
লেখক শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy