Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

লছিপুরের বাচ্চাদের পাশে দিশা

মূলত যৌনকর্মীদের মধ্যে নানা বিষয়ে সচেতনতা তৈরি, তাঁদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, চিকিৎসার ব্যবস্থা করা-সহ নানা লক্ষ্যে প্রায় তিন দশক ধরে কাজ করে চলেছে ‘দিশা’। আসানসোলের পুলিশ-কর্তাদের উদ্যোগেই সংগঠনটি তৈরি হয়।

ক্লাসে: দিশা জনকল্যাণ কেন্দ্রের শিক্ষাকেন্দ্র। নিজস্ব চিত্র

ক্লাসে: দিশা জনকল্যাণ কেন্দ্রের শিক্ষাকেন্দ্র। নিজস্ব চিত্র

সুশান্ত বণিক
আসানসোল শেষ আপডেট: ১৪ নভেম্বর ২০১৭ ০৬:৩০
Share: Save:

মা-বাবা এড্স আক্রান্ত। তাঁদের মেয়ে তখন চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী। বাবা-মা মারা গেলেন। সেই ‘সুযোগে’ এলাকার আর পাঁচটা মেয়ের মতো তাকেও পাচার করে দিতে চেষ্টা করেছিল দালালেরা। কিন্তু রুখে দাঁড়ালেন শিক্ষক-শিক্ষিকারা। সেই মেয়ে এখন কলকাতায় একটি স্কুলে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী। উচ্চ শিক্ষার স্বপ্ন দেখে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছেন তিনি।

— এ ভাবেই কুলটির লছিপুর যৌনপল্লিতে শৈশবকে বাঁচিয়ে, তাকে লালন করার চেষ্টা করে চলেছে ‘দিশা জনকল্যাণ কেন্দ্রে’র প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্রটি।

মূলত যৌনকর্মীদের মধ্যে নানা বিষয়ে সচেতনতা তৈরি, তাঁদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, চিকিৎসার ব্যবস্থা করা-সহ নানা লক্ষ্যে প্রায় তিন দশক ধরে কাজ করে চলেছে ‘দিশা’। আসানসোলের পুলিশ-কর্তাদের উদ্যোগেই সংগঠনটি তৈরি হয়। কয়েক বছর যেতে না যেতেই পুলিশ-কর্তা এবং সংগঠনের সদস্যরা ঠিক করেন, সমাজের মূল স্রোতের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে যৌনকর্মীদের সন্তানদের। ১৯৯৭ সালে প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্রটি তৈরি হয়। ক্লাস হয়, প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত। তার পরে পড়ুয়াদের অন্য স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের দায়িত্বে রেখে উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়।

চার কামরার দোতলা ভবনে চলে শিক্ষাকেন্দ্রটি। পড়ুয়ার সংখ্যা শতাধিক। সংগঠনের সদস্যরাই এলাকায় ঘুরে ঘুরে পড়ুয়াদের ক্লাসমুখী করায় উদ্যোগী হন।

আদতে কাটোয়ার বাসিন্দা, সঙ্গীতা ঢালি (নাম পরিবর্তিত) জানান, প্রায় তিন দশক আগে শ্বশুরবাড়ির অত্যাচারের কারণে কাটোয়া থেকে লছিপুরে আসেন। স্বেচ্ছায় নামেন যৌন ব্যবসায়। তাঁর মেয়েও একই পেশায় রয়েছেন। কিন্তু সঙ্গীতাদেবীর বছর দশেকের নাতনি স্কুলে যায়। সঙ্গীতাদেবী বলেন, ‘‘চার ক্লাস পাস দিলেই নাতনি আমার হস্টেলে যাবে। অনেক পড়বে।’’ ছেলেকে নিয়ে একই ধরনের ইচ্ছে বাংলাদেশ থেকে আসা সুহানা খাতুনেরও (নাম পরিবর্তিত)।

খুদে পড়ুয়াদের আঁকা, হস্তশিল্প, আবৃত্তি, কম্পিউটার প্রশিক্ষণ-সহ নানা বিষয়ে তালিম দেওয়া হয় বলে জানান সংগঠনটির কোষাধ্যক্ষ সোমনাথ মিত্র। শিক্ষাকেন্দ্রে দুপুরের খাবার দেয় আসানসোল পুরসভা।

শিক্ষাকেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত প্রধান দেবব্রত অধিকারী জানান, এ পর্যন্ত ১৮ জন ছাত্রী এবং এক জন ছাত্রকে উচ্চশিক্ষার জন্য দক্ষিণ ২৪ পরগনার একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। এঁদের অনেকেই পড়াশোনা শেষ করে চাকরি পেয়েছেন বা স্বনির্ভর হয়েছেন। যেমন, এলাকারই এক যৌনকর্মীর ছেলে গত বছর ইসিএল-এ মাইনিং সর্দার পদে চাকরি পেয়েছেন। আর এক যৌনকর্মীর একমাত্র মেয়ে পড়ছেন ওকালতি।

আগামী দিনে এই শিক্ষাকেন্দ্রের নতুন ভবন তৈরির জন্য প্রায় সাড়ে তিন বিঘে জমি কেনা হয়েছে। নানা সরকারি ক্ষেত্র থেকে প্রায় চার লক্ষ টাকা অনুদান মিলেছে।

তবে যৌনকর্মীদের ছেলেমেয়েরাও এড্স আক্রান্ত হলে গোটা প্রক্রিয়াটা অত্যন্ত কঠিন হয়ে যায় বলে জানান সংগঠনের সদস্যরা। তাঁরা জানান, সে ক্ষেত্রে ওই খুদে পড়ুয়াদের চিকিৎসার পাশাপাশি পড়াশোনা চালিয়ে নিয়ে যাওয়াটা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। সে ক্ষেত্রে ওই পড়ুয়াদের শুরু থেকেই বারুইপুরের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের হাতে তুলে দেওয়া হয়।

তবে নানা বাধাবিঘ্ন পেরিয়েও এই শিশুদের স্বপ্ন দেখাচ্ছে শিক্ষাকেন্দ্রটি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Education লছিপুর
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE