Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

‘ভয় দেখিয়েছে, এখান থেকে বেরতে চেষ্টা করলে জানে মেরে দেবে’

শতাধিক বছরের পুরনো এই পল্লিতে নিয়মিতই এ ভাবে এসে পড়েন নিতান্ত নিরুপায় নাবালিকা, কিশোরী ও যুবতীরা। চড়া দর হেঁকে তাদের তুলে এনে জোর করে যৌন ব্যবসায় নামায় মেহেতাব আলি, মনীশ সিংহ, রাজু শেখ, চুমকি রেহানা বা হাসিবুল শেখের মতো দালালেরা।

— প্রতীকী ছবি।

— প্রতীকী ছবি।

সুশান্ত বণিক
আসানসোল শেষ আপডেট: ০৬ নভেম্বর ২০১৭ ০২:০৩
Share: Save:

বছর বাইশের যুবতী, ফতিমা খাতুনের (নাম পরিবর্তিত) বাড়ি, বাংলাদেশে। ছোট দুই ভাই-বোন ও মায়ের সংসারে সেলাই জানা ফতিমার রোজগারই ছিল একমাত্র সম্বল। বেশি রোজগারের স্বপ্ন দেখিয়ে প্রতিবেশী মাহফুজ তাঁকে বছর তিনেক আগে কলকাতায় এনে তোলে। আশ্বাস ছিল, সেখানেই সেলাইয়ের কাজ করে মাসের শেষে বাড়িতে টাকা পাঠাতে পারবেন ফতিমা। কিন্তু দু’দিন থাকার পরেই বিক্রি করে দেওয়া হয় ফতিমাকে। ক্রেতা জনৈক আসরাফ। মেয়েটির ঠাঁই হয় লছিপুর যৌনপল্লিতে। মাস কয়েক সেখানে কাটাতে না কাটাতেই ফের বিক্রি। এ বার মুম্বই। ফতিমা বলেন, ‘‘দু’বছর সেখানে কাটিয়ে ফিরেছি লছিপুরে। ইচ্ছে ছিল, আসরাফের উপরে প্রতিশোধ নেব। কিন্তু ফিরে শুনি, সে দুর্ঘটনায় মরেছে। সেই থেকে এখানেই আছি। বাড়ি ফিরে যাইনি।’’

পশ্চিম বর্ধমানের কুলটির নিয়ামতপুর লাগোয়া লছিপুর ও চবকা যৌনপল্লির গলিতে ঘুরলে এমন কাহিনি শোনা যায় আকছার। শতাধিক বছরের পুরনো এই পল্লিতে নিয়মিতই এ ভাবে এসে পড়েন নিতান্ত নিরুপায় নাবালিকা, কিশোরী ও যুবতীরা। চড়া দর হেঁকে তাদের তুলে এনে জোর করে যৌন ব্যবসায় নামায় মেহেতাব আলি, মনীশ সিংহ, রাজু শেখ, চুমকি রেহানা বা হাসিবুল শেখের মতো দালালেরা।

কী ভাবে চলে এই নারী পাচার?

বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়ে আসা ‘দুর্বার মহিলা সমিতি’র সদস্যা রোকেয়ার দাবি, বেনাপোল রেললাইন লাগোয়া বেড়া ডিঙিয়ে বা হাসনাবাদ ও টাকির নদীপথ পেরিয়ে বাংলাদেশি দালালেরা মহিলাদের নিয়ে এসে নিজেদের ‘ডেরা’য় রাখে। তাঁদের জন্য ভোটার কার্ড বা আধার কার্ড তৈরি করা হয় আইন ভেঙে। পরে ওই মহিলাদের বেচে দেওয়া হয় কলকাতার দালালদের কাছে। সেখান থেকে ফের হাতবদল করে দালালেরা এঁদের লছিপুরে আনে। পাচার করে আনা মহিলাদের প্রথমে স্ত্রী পরিচয় দিয়ে লছিপুর লাগোয়া গাঁধী কুষ্ঠ কলোনির পিছনের আবাসনে রাখে। সুযোগ বুঝে লছিপুর বা চবকা যৌনপল্লিতে নিয়ে আসে। তার পরে যৌন ব্যবসায় নামতে বাধ্য হন সেই মহিলারা। মুর্শিদাবাদ, উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাট, দক্ষিণ ২৪ পরগনার ডায়মন্ডহারবার, নামখানা, উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়ি, এমনকী, নেপাল থেকেও মহিলাদের আনা হচ্ছে এ ভাবে।

স্বেচ্ছায় কেউ যৌন ব্যবসায় নামলে কারও কিছু বলার নেই। কিন্তু নাবালিকা বা পাচার করে আনা কোনও মহিলাকে জোর করে যৌন ব্যবসায় নামানোর চেষ্টা হলে বাধা দেয় ‘দুর্বার মহিলা সমিতি’। সমিতির স্থানীয় শাখার সম্পাদক রবি সিংহ জানিয়েছেন, তাঁদের ১৮ জন ‘ফিল্ড ওয়ার্কার’ নিয়মিত পল্লিতে ঘোরেন। নতুন মহিলার সন্ধান পেলেই খবর নেন সে নাবালিকা কি না, ধরে এনে তাকে ব্যবসায় নামানোর চেষ্টা হচ্ছে কি না। নাবালিকা সন্দেহ হলে তাকে জেলা হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করে দেখা হয়। নাবালিকা প্রমাণ হলে, তাকে সরকারি ব্যবস্থায় বাড়ি ফেরত পাঠানো হয়।

তবে ‘দুর্বার’-এর সদস্যদের অভিজ্ঞতা, অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, মেয়েটি বা মহিলাকে পাচারে বাড়ির লোকেরও প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে। অভাবের অজুহাতে বিক্রি করা হয়েছে মেয়েকে। তাই সে বাড়িতে ফিরে শান্তি মেলে না। জামুড়িয়ার এক মহিলাকে যেমন বাড়িতে ফেরানো হলেও, পরিবার ফেরত না নেওয়ায় তিনি ফিরে এসেছেন লছিপুরেই।

অন্য অভিজ্ঞতাও হয়েছে ‘দুর্বার’-এর সদস্যদের। সম্প্রতি উদ্ধার হওয়া চার জন নাবালিকাকে উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাট-হাসনাবাদ এলাকায় ফেরত দিতে গিয়ে মার খেয়েছেন দুর্বারের সদস্য মাসুদা বিবি ও মালা দাস। তাঁরা বলেন, ‘‘মেয়েগুলোর বাড়ির লোকেরা আমাদেরই পাচারকারী ভেবে মারধর করতে শুরু করে। কোনও মতে বুঝিয়ে ছাড়া পেয়েছি।’’

‘দুর্বার মহিলা সমিতি’র সদস্যদের একটা বড় অংশের মত— দালালদের হুমকির মুখে পাচার হয়ে আসা অনেক মহিলাই প্রশাসন বা দুর্বারের কাছে তা স্বীকার করেন না। ফলে, তাঁদের উদ্ধার করে ফেরত পাঠানোও সম্ভব হয় না।

উত্তর ২৪ পরগনার বারাসত এলাকা থেকে আসা ‘মালতী’ যেমন। জানালেন, বছর কয়েক আগে এক পড়শিকে ভরসা করে চাকরির আশায় ঘর ছেড়ে বেরিয়েছিলেন। নানা হাতে ঘুরে লছিপুরে এসে পালানোর চেষ্টা করতে গিয়ে দালালের মার খেয়ে রক্তাক্ত হন। হাত-মুখে ক্ষতচিহ্ন দেখিয়ে মালতী বলেন, ‘‘ভয় দেখিয়েছে, এখান থেকে বেরোতে চেষ্টা করলে জানে মেরে দেবে। সে চেষ্টা ছেড়ে দিয়েছি। তার পরেও ব্লেড দিয়ে চিরে দেয়। সিগারেটের ছেঁকা দেয়। তাই মুখ খুলি না।’’ আসানসোল-দুর্গাপুর কমিশনারেটের এক পুলিশ-কর্তা বলেন, ‘‘নারী পাচারের অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়। পুলিশ অনেককে উদ্ধারও করেছে। কিন্তু মেহেতাব আলি, মনীশ সিংহ, রাজু শেখদের মতো দালালদের বিরুদ্ধে সরাসরি কেউ লিখিত অভিযোগ করে না। ওরা সেই সুযোগটাই নিচ্ছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Human Trafficking Middle Men লছিপুর
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE