লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের বিপুল সাফল্য সত্ত্বেও মালদহ, মুর্শিদাবাদ কিংবা আসানসোল যে ঈষৎ চোনা ফেলে দিয়েছে, ঘনিষ্ঠদের কাছে সে আক্ষেপ আড়াল করেননি ক্ষুব্ধ দলনেত্রী। রাজ্যে ৩৪/৪২ ফলের পরেও তাই ওই ছয় আসনে পরাজয়ের দ্রুত ময়নাতদন্ত শেষে ভোটের-সেনাপতিদের ‘শাস্তি’ দিতেও কসুর করেননি তিনি।
কিন্তু হারের পিছনে দায়ী কি শুধু সেনাপতিরাই? দলে সমান্তরাল ভাবে উঠে গিয়েছে এ প্রশ্নও।
মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর এবং জঙ্গিপুর আসনে প্রার্থীদের ‘দায়বদ্ধতা’ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন জেলা নেতারা। মালদহ (উত্তর) কেন্দ্রের প্রার্থী সম্পর্কে জেলার এক তাবড় নেতার মন্তব্য ছিল, “প্রচারে ওঁর প্রবল অনীহা ছিল। দলীয় কর্মীদের কাছে ‘ভূমি’ ভাঙিয়ে বক্তব্য রাখলেও মালদহের ভূমি চেনার কোনও চেষ্টাই করেননি উনি।”
সেই তালিকায় শেষ সংযোজন দোলা সেন।
আসানসোলে ভরাডুবির পরে ওই কেন্দ্রে নিবার্চনী দায়িত্বে থাকা কৃষিমন্ত্রী মলয় ঘটকের মন্ত্রিত্ব গিয়েছে। কিন্তু প্রার্থী দোলা সেনের ‘দুর্ব্যবহার’ নিয়ে কোনও প্রশ্ন তোলা হবে না কেন? আসানসোল ও তার আশপাশের বিভিন্ন এলাকার নেতা-কর্মীরা এ বার এই প্রশ্ন তুলছেন।
জেলা নেতাদের একাংশের সরাসরি অভিযোগ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মর্যাদার আসন আসানসোলের প্রার্থী দোলার ‘ব্যবহার’ই তাঁকে ভরাডুবির দিকে ঠেলে দিয়েছে। আসানসোলের এক প্রভাবশালী নেতার কথায়, “প্রার্থী হয়েই দোলা ভেবেছিলেন জয় শুধু সময়ের অপেক্ষা। আমরা বহুবার ওঁকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি, আসানসোলে ভোটের জমি অন্যরকম। এখানে লড়াই ছিনিয়ে নিতে হয়।” তৃণমূলের ওই নেতা জানান, প্রথমবার আসানসোলে এসেই দলের শ্রমিক ফ্রন্টের ওই নেত্রী ঘোষণা করেছিলেন, ‘আমি দিদির প্রার্থী। আমার কাউকে দরকার নেই।’ দলীয় কর্মীদের পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশও ছিল তাঁর ‘উপেক্ষার পাত্র।’ প্রবল এই ‘উপেক্ষা’ আর নেতা-কর্মীদের ‘তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য’ করাই তাঁকে ‘একা’ করে দিয়েছিল বলে মনে করছেন দলীয় নেতারা।
অন্য দিকে, বিজেপি প্রার্থী বাবুল সুপ্রিয় তাঁর ‘সেলিব্রিটি’ ভাবমূর্তি সরিয়ে রেখে সাধারণ মানুষ ও দলীয় কর্মীদের এতটাই কাছের হয়ে উঠতে পেরেছিলেন নিছক ‘স্বভাব গুণে’। এমনটাই মনে করছেন রানিগঞ্জের এক তাবড় তৃণমূল নেতা। তাঁর ব্যাখ্যা, “দু-জনের স্বভাবে এতটাই ফারাক ছিল যে দলের নিচুতলার কর্মীদের অনেকেই বলতেন দোলাদেবীর হয়ে আমরা প্রচার করতে পারব না। নির্বাচনের মুখে বহু দলীয় কর্মীই হয় উৎসাহ হারিয়ে বসে গিয়েছিলেন। না হলে শিবির বদল করে বিজেপি’র দিকে ঢলে পড়েছিলেন।”
আসানসোল (উত্তর) কেন্দ্রের তৃণমূল নেতা আবু কানন স্পষ্টই বলছেন, “দোলাদেবী কারও কাছে ভোটই চাইলেন না। ভোটারদের সঙ্গে দেখা হলেই তিনি বলতেন, তিনি জিতেই গেছেন, ১৬ মে-র পর এলাকার সমস্যা বুঝে নেবেন। দলীয় কর্মী থেকে সাধারণ ভোটার, অপছন্দ হলেই হুমকি দিতেন, ‘ছাড়ব না, ভোটটা মিটুক দেখে নেব।” ক্রমান্বয়ে এই ‘হুমকি’ আর ‘হম্বিতম্বি’তে কর্মীরা তাঁর কাছে ঘেঁষতেই চাইতেন না। তাঁদের অনেকেই জানান, প্রার্থী নিজেকেই ‘দিদি’ (মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) বলে ভাবতে শুরু করেছিলেন।
কেমন ছিল দোলার ব্যবহার?
ঘটনা১: সরকারি ছুটি থাকায় অতিরিক্ত জেলাশাসকের দফতরে মনোনয়ন পেশ করতে প্রথম দিন গিয়ে ফিরে আসতে হয়েছিল দোলা সেনকে। দ্বিতীয় দিন মনোনয়ন জমা দিয়ে এডিএম অমিত দত্তকে তাঁর প্রশ্ন ছিল, “আমায় দু’বার আসতে হল কেন?” অমিতবাবু তাঁকে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করতেই দোলা বলে ওঠেন, “১৬ তারিখের পর আপনাকেও আমি দেখে নেব।”
ঘটনা২: ভোটের দিন কয়েক আগে জামুড়িয়ার ছোলাডাঙায় প্রচারে গিয়ে দোলা দেখেন পঞ্চায়েত প্রধান অনুপ মণ্ডল নেই। সবার সামনেই তিনি দলীয় কর্মীদের হুকুম দেন, “যা প্রধানকে ডেকে নিয়ে আয়। আমার নাম শুনলে ওর বাবা আসবে।” অনুপবাবু বলেন, “আমাকে যারা খবর দিতে এসেছিল তাঁদের মুখেই শুনি উনি বাপ তুলে গালমন্দ করেছেন। আমি কিছু মনে করিনি। তবে কী জানেন, তার পর স্থানীয় বাসিন্দারা বলতে থাকেন, ভোটে দাঁড়িয়েই যদি প্রধানকে গালি দেয়, তা হলে ভোটে জিতলে তিনি কী আচরণ করবেন!”
ঘটনা৩: রানিগঞ্জের এগরায় সভা করতে গিয়ে প্রার্থী দেখেন সাকুল্যে শ-খানেক লোক। বিধায়ক তাপস বন্দ্যোপাধ্যায় ও রানিগঞ্জ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি সেনাপতি মণ্ডলের সামনেই দোলা সে দিন চিৎকার করে সেনাপতিকে শাসিয়েছিলেন, “ইয়ার্কি হচ্ছে? এই ক’টা লোক নিয়ে আমাকে দিয়ে সভা? সেনাপতি, ভোটের পর আমি তোমাকে দেখে নেব।”
কোথাও হুমকি কোথাও বা উপেক্ষা না হয় কথায় কথায় রাগ-রোষনির্বাচনের আগে প্রায় দেড় মাস ধরে এমনই অজস্র অভিযোগের পাহাড় জমেছিল তাঁর বিরুদ্ধে।
নিবার্চনের মুখে অভিযোগের সেই সারণিতে শেষ সংযোজন, ফেসবুকে স্থানীয় এক সমাজবিরোধীর সঙ্গে ফুচকা খাওয়ার দৃশ্য। যা দেখে দলীয় নেতাদের অনেকেই পরের দিন তাঁর সঙ্গে প্রচারে যেতে অস্বীকার করেছিলেন। কলকাতা থেকে তাঁর ‘ভোট-মেশিনারি’ হিসেবে পরিচিত সমাজবিরোধীদের আসানসোলে নিয়ে আসাও অস্বস্তিতে ফেলেছিল স্থানীয় নেতাদের। এক নেতার কথায়, “কিন্তু দোলা আমাদের কথা শুনলে তো!”
এ সব অভিযোগই কানে গিয়েছে দোলা সেনের। তবে কথা বলার সেই চেনা ভঙ্গি ছাড়তে পারেননি। দোলা বলছেন, “হারের কারণ ব্যাখ্যা করার আপনারা কে? দলে নেত্রী আছেন, তিনিই সব খতিয়ে দেখবেন।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy