অভিযুক্ত সমীর দাস ও অভিজিৎ হালদার। ছবি: শান্তনু হালদার
নির্বাচনী প্রচারে হাবরার একটি দেওয়াল-লিখনের ছড়ায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘চোর’ বলায় এক কলেজ ছাত্র-সহ গ্রেফতার করা হল দুই সিপিএম সমর্থককে। তাঁদের বিরুদ্ধে মানহানি, অবাঞ্ছিত প্রভাব খাটানো এবং শান্তিভঙ্গের মামলা করল পুলিশ।
দিন কয়েক আগে মছলন্দপুরের তিন আমতলা এলাকার একটি বাড়ির দেওয়ালে সিপিএম ও তাদের ছাত্র সংগঠন এসএফআইয়ের পক্ষ থেকে ১৬ লাইনের একটি ছড়া লেখা হয়। যার প্রথম কয়েকটি লাইন ছিল, ‘বলছে এখন জনতা, বড় চোর মমতা/পাশ করতে টেট, নবান্নে চাই ভেট...’। সেখানে কংগ্রেস এবং নরেন্দ্র মোদীরও নাম ছিল।
ওই ছড়ায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কটূক্তি করা হয়েছে, এই অভিযোগ তুলে দিন কয়েক আগে উত্তর ২৪ পরগনা জেলা প্রশাসন এবং নির্বাচন কমিশনের দ্বারস্থ হয় তৃণমূল। তদন্তে নামে জেলা প্রশাসন। তাদের নির্দেশমতো শনিবার সকালে ওই ছড়ায় নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় মছলন্দপুরের বিধান পল্লির সিপিএম সমর্থক, বছর ছাব্বিশের সমীর দাস ও ৩ আমতলার এসএফআই কর্মী, বছর উনিশের অভিজিৎ হালদারকে। অভিজিৎ স্থানীয় কলেজের কলা বিভাগের ছাত্র। দু’জনেই দলের নির্দেশে স্থানীয় ফাঁড়িতে আত্মসমর্পণ করেন। ধৃতদের বারাসত আদালতে হাজির করানো হলে জামিন পান।
ধৃতদের অবশ্য দাবি, ওই ছড়ার আগে-পরে কিছু শব্দ যোগ করে তাঁদের ফাঁসানো হয়েছে। অভিজিৎ বলেন, “আমরা একটা শায়েরি লিখেছিলাম। এটা যে আইনত দণ্ডনীয় জানতাম না।” সমীর বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়ে কিছু বললেই এ রকম অবস্থা হয়। কোমরে দড়ি পরে।” স্থানীয় সিপিএম নেতা অসীম ঘোষ জানিয়েছেন, দলের নির্দেশে ওই দেওয়াল লেখা হয়নি। কিছু দলীয় সমর্থক অতি উৎসাহে লিখে ফেলেছিলেন। জানার পরে তা মুছে দেওয়া হয়।
দেওয়াল-লিখনে ছড়ার ব্যবহার নতুন নয়। বঙ্গের ভোটরঙ্গে তা এক রকম সংস্কৃতিই হয়ে গিয়েছে। বফর্স কেলেঙ্কারির সূত্র ধরে ১৯৮৯
সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে এ রাজ্যের দেওয়াল ছয়লাপ হয়ে গিয়েছিল বিরোধীদের দু’লাইনের একটি ছড়ায় ‘গলি গলি মে শোর হ্যায়, রাজীব গাঁধী চোর হ্যায়’। তার পর থেকে গত বিধানসভা নির্বাচন পর্যন্ত দেওয়াল-লিখনের ছড়ায় নেতা-নেত্রীদের ব্যঙ্গ কম করা হয়নি। নেতাই কাণ্ড নিয়ে তৃণমূলের একাধিক দেওয়াল-লিখন এবং পোস্টার-ব্যানারে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে ‘খুনি’ তকমাও দেওয়া হয়। কিন্তু এ বার যে ভাবে দু’জনকে গ্রেফতার করা হল, তা সাম্প্রতিক সময়ে নজিরবিহীন। জেলাশাসক ওঙ্কার সিংহ মিনা জানিয়েছেন, ওই দেওয়াল-লিখনে যে ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, তা ব্যক্তিগত আক্রমণ। সেটি নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছে। বিষয়টি বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রের রিটার্নিং অফিসার খতিয়ে দেখেছেন।
যে এলাকায় ওই দেওয়াল-লিখন হয়েছিল, সেটি বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রে পড়ে। ওই কেন্দ্রের রিটার্নিং অফিসার তথা অতিরিক্ত জেলাশাসক (ভূমি ও ভূমি সংস্কার) বলেন, “আমরা ওই দেওয়াল-লিখন খতিয়ে দেখেছি। ভাষায় নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গ হয়েছে। তাই পুলিশকে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।” ভারতীয় দণ্ডবিধি অনুযায়ী, অবাঞ্ছিত প্রভাব খাটানো (১৭১ এফ), মানহানিকর কিছু ছাপানো (৫০১) এবং শান্তিভঙ্গের উদ্দেশ্যে ইচ্ছাকৃত অপমান (৫০৪) এই তিনটি ধারায় সমীর এবং অভিজিতের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করেছে পুলিশ। আইনজীবীরা জানিয়েছেন, ধৃতদের সর্বোচ্চ দু’বছর কারাবাস বা জরিমানা বা দু’টি শাস্তিই এক সঙ্গে হতে পারে। রাজ্য নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানানো হয়েছে, নির্বাচনী বিধিতে বলা রয়েছে, ব্যক্তি কুৎসা বা ব্যক্তিকে আক্রমণ করা যাবে না।
সিপিএমের দাবি, লঘু পাপে গুরুদণ্ড দেওয়া হয়েছে তাদের দুই সমর্থককে। নির্বাচন কমিশন হাবরা থানায় দেওয়াল-লিখনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিলেও তিনটি ধারায় মামলা রুজু করেছে পুলিশই। দলের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য নেপালদেব ভট্টাচার্য বলেন, “পুলিশ যে সব ধারায় মামলা রুজু করেছে, তাতে প্রমাণ হয় থানাগুলি তৃণমূলের পার্টি অফিসে পরিণত হয়েছে।” এক সিপিএম নেতার কটাক্ষ, “তাঁর দলের সঙ্গে ‘চোর’ শব্দের সংযোগ ঘটিয়েছেন তো মুখ্যমন্ত্রী নিজেই। সারদা-কাণ্ড সামনে আসার পরে শ্যামবাজার এবং সোদপুরে দু’টি সভায় তিনিই তো বলেছিলেন, ‘তা হলে কি আমি চোর! মুকুল চোর! কুণাল চোর!’’
জেলা পুলিশের এক কর্তা দাবি করেছেন, ধারাগুলি নির্ভর করে অভিযোগের উপরে। এ ক্ষেত্রে যে অভিযোগ হয়েছে, তার ভিত্তিতেই ধারাগুলি দেওয়া হয়েছে। তৃণমূলের জেলা পর্যবেক্ষক জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক অবশ্য বলেন, “ওই কুৎসার পিছনে যে সিপিএম জড়িত, দু’জনকে গ্রেফতারের ঘটনায় তা প্রমাণিত।”
জেলাশাসকের দাবি, শুধু মছলন্দপুরই নয়, আরও কিছু জায়গায় দেওয়াল-লিখনে ভাষা ব্যবহারে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘিত হওয়ায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করে ইতিমধ্যেই কয়েক জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং তাঁরা জামিনও পেয়েছেন। তবে, তৃণমূলের কোনও কর্মী-সমর্থকের নামেও অভিযোগ এসেছে কি না, সে ব্যাপারে নির্দিষ্ট ভাবে তিনি কিছু জানাতে পারেননি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy