Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

স্যারদের চেষ্টায় উদ্ধার দশ বছরের ‘নববধূ’

মাত্র দশ বছরের সরস্বতীকে (নাম পরিবর্তিত) বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলেন মা, দিদিমা। পাত্র বছর তেইশের এক মূর-বধির যুবক। কাজ করেন দিন মজুরের। সে খবর কানে যেতেই শ্রীরামপুরের নওগাঁর শুভঙ্কর পোল্লে দলবল জুটিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন মুর্শিদাবাদের প্রত্যন্ত গ্রামে। সঙ্গে পুলিশ-প্রশাসন।

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

প্রকাশ পাল
শেওড়াফুলি শেষ আপডেট: ০৩ মার্চ ২০১৮ ০৬:০২
Share: Save:

শ্বশুরবাড়ি থেকে দিদিমার বাড়ি এসে বসেছিল নববধূ। মা দেখতে এসেছে তাকে। হঠাৎ ঘরের দাওয়ায় ‘শুভঙ্কর স্যার’কে দেখে নেচে উঠল চোখ। মুখের আগল খুলতেও মুহূর্ত দেরি হয়নি— ‘‘আমাকে নিয়ে চলো স্যার। ওরা আমার বিয়ে দিয়ে দিল জোর করে।’’

মাত্র দশ বছরের সরস্বতীকে (নাম পরিবর্তিত) বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলেন মা, দিদিমা। পাত্র বছর তেইশের এক মূর-বধির যুবক। কাজ করেন দিন মজুরের। সে খবর কানে যেতেই শ্রীরামপুরের নওগাঁর শুভঙ্কর পোল্লে দলবল জুটিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন মুর্শিদাবাদের প্রত্যন্ত গ্রামে। সঙ্গে পুলিশ-প্রশাসন।

আপাতত মেয়েটি বহরমপুরের সরকারি হোমে। এ বার থেকে সেখানেই চলবে তার লেখাপড়া, সঙ্গে সংস্কৃতির চর্চা— আশ্বাস দিয়েছেন প্রশাসনিক কর্তারা।

ছোট্ট সরস্বতীর সঙ্গে শুভঙ্করের দেখা বছর কয়েক আগে। শেওড়াফুলি স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে বড় হচ্ছিল সে দিদিমার কাছে। দিদিমা ভিক্ষা করেন। বাবা মারা গিয়েছেন। মা ফের বিয়ে করে অন্যত্র থাকেন।

বছর কয়েক ধরে শুভঙ্কর ওই প্ল্যাটফর্ম-শিশুদের পড়ানো শুরু করেন ‘বর্ণপরিচয়’ নামে একটি সংস্থার নামে। সরস্বতীও আসত সেখানে। ২০১৬ সালের শেষে তাঁর হাত ধরেই স্থানীয় প্রাথমিক স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হয় সরস্বতী। এ বার চতুর্থ শ্রেণি— কিন্তু তিন মাস আগে তাকে পড়া ছেড়ে ফিরে যেতে হয়েছে মুর্শিদাবাদের সালারে।

শুভঙ্কর জানান, সেখানে সরস্বতীর দিদার মাটির বাড়ি। পুজোর নাম করে সরস্বতীকে সেখানে নিয়ে যান মা-দিদিমা। দিদিমা ফিরলেও সরস্বতী আর আসেনি।

দিন কয়েক আগে খবর মেলে, তার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। এর পর গত সোমবার শুভঙ্কর, শিবতলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের (সরস্বতী এই স্কুলেই ভর্তি হয়েছিল) প্রধান শিক্ষক সঞ্জীব বারিক, মন বন্দ্যোপাধ্যায়, মিতালি নাথ, সৌরভ ভাওয়ালরা ট্রেনে চেপে সালারে যান। সকলেই ‘বর্ণপরিচয়’-এর সদস্য।

জানা ছিল না মুর্শিদাবাদের প্রশাসনিক কর্তাদের ফোন নম্বর। ট্রেনে বসেই তাঁরা জোগাড় করেন ভরতপুর-২ বিডিও অর্ণবকুমার চিন্নার নম্বর। সালার থানার পুলিশ এবং শুভঙ্করদের নিয়ে বিডিও অর্ণববাবু পৌঁছে যান দত্তবাটি দাসপাড়ায় মেয়েটির দিদিমার বাড়িতে। সরস্বতীর আর্তি, সংসার নয়, পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়।

ব্লক প্রশাসনের তরফে মেয়েটির মা-দিদিমার নামে সালার থানায় ডায়েরি করা হয়। বিডিও-র কথায়, ‘‘ওর দিকে লক্ষ্য রাখব। জেলা চাইল্ড প্রোটেকশন কমিটি’র সঙ্গে কথা বলেছি।’’

নাবালিকা উদ্ধারের এই গল্পে অবশ্য একটি বিশেষ ভূমিকায় রয়েছেন সরস্বতীর এক দাদা। বছর বাইশের সেই যুবকও বেড়ে উঠেছে শেওড়াফুলি স্টেশনেই। এখন একটি বেসন তৈরির কারখানায় কাজ করেন। বাড়ি ভাড়া করে থাকেন শেওড়াফুলিতেই। তিনিই প্রথম এক আত্মীয় মারফত বোনের বিয়ের খবর পান।

তাঁর কথায়, ‘‘ছোট্ট বোনটার এমন সর্বনাশ কী করে মেনে নেব! সঙ্গে সঙ্গে শুভঙ্কর স্যারকে জানাই। ওঁরা বোনকে যে ভাবে উদ্ধার করেছেন, ওঁদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।’’

দাদাও চান, বোন অনেক বড় হোক। এমনকী হোম থেকে নিয়ে এসে নিজের কাছে রাখতে চান তিনি। যাতে ‘শুভঙ্কর স্যার’দের সান্নিধ্যে মানুষ হয়ে উঠতে পারে সরস্বতী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Child Marriage Serampore
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE