Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

কাতরাচ্ছেন মুমূর্ষু, নড়ল না কেউ

বাকিরা কেউ এগোলেন না কেন? অরূপবাবুর মতে, ‘‘ওই সময়ে অধিকাংশ যাত্রীই খুব তাড়াহুড়োয় ছিলেন। সেই সঙ্গে পুলিশি ঝামেলার ভয় তো আছেই।’’

নির্বিকার: মৃত কিশোরকুমার মাইতি।

নির্বিকার: মৃত কিশোরকুমার মাইতি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ১২ জানুয়ারি ২০১৮ ০১:৪৩
Share: Save:

সকাল পৌনে ন’টা। ভিড়ে ঠাসা স্টেশনের পাশেই লেভেল ক্রসিং। রেললাইনের ধারে পড়ে আছেন পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই এক ব্যক্তি। ছটফট করছেন অসহনীয় যন্ত্রণায়। চিৎকার করে সাহায্য চাইছেন আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনের। ট্রেনের চাকায় গোড়ালি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে তাঁর ডান পা। রক্তে ভেসে যাচ্ছে শিশিরে ভেজা মাটি। লেভেল ক্রসিং আর প্ল্যাটফর্ম মিলিয়ে সেখানে তখন কয়েকশো যাত্রীর ভিড়। কিন্তু সাহায্যের একটি হাতও এগিয়ে এল না ধাড়সা মনসাতলার বাসিন্দা কিশোরকুমার মাইতির (৪৯) দিকে। শীতের সকালে ট্রেনের ধাক্কায় জখম কিশোরবাবু যখন তিলে তিলে শেষ হয়ে যাচ্ছেন, তখন সেখানে দাঁড়িয়েই সেই দৃশ্য দেখলেন অসংখ্য মানুষ। কেউ তাঁকে বাঁচাতে ছুটে গেলেন না। অথচ, তাঁরা একটু উদ্যোগী হলেই হয়তো প্রাণে বেঁচে যেতেন ওই ব্যক্তি। শুধু যাত্রীরাই নন, স্টেশনের কর্মীরাও কেউ এগিয়ে আসেননি বলে অভিযোগ। ঘণ্টাখানেক পরে রেলের অ্যাম্বুল্যান্স যখন ঘটনাস্থলে পৌঁছয়, কিশোরবাবুর তখন মৃত্যু হয়েছে।

বৃহস্পতিবার হাওড়া শহরে ঘটনাটি ঘটেছে দক্ষিণ-পূর্ব রেলের রামরাজাতলা স্টেশনে। রেলকর্তাদের যুক্তি, সেটি যে হেতু হল্ট স্টেশন, তাই রেলের কোনও স্থায়ী কর্মী সেখানে থাকেন না। যাঁরা আছেন, তাঁরা বেসরকারি সংস্থার চুক্তিভিত্তিক কর্মী। এমন দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়ার পরিকাঠামোও নেই ওই স্টেশনে।

দক্ষিণ-পূর্ব শাখার গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন রামরাজাতলা। কাজের দিনে সকাল থেকেই সেখানে ভিড় উপচে পড়ে। রেল পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে খবর, এ দিন সকাল পৌনে ন’টা নাগাদ ভিড়ে ঠাসা ওই স্টেশনে ট্রেন ধরার হুড়োহুড়ি যখন তুঙ্গে, তখন এক নম্বর লাইন দিয়ে হাওড়ার দিক থেকে কারশেডের দিকে যাচ্ছিল জঙ্গলমহল এক্সপ্রেস। স্টেশনে ঢোকার পরেই ট্রেনের গতি অনেকটা কমিয়ে দিয়েছিলেন চালক। কিন্তু ট্রেন ঢুকছে দেখেও প্ল্যাটফর্ম সংলগ্ন বন্ধ লেভেল ক্রসিং দিয়ে চলছিল ঝুঁকি নিয়ে লাইন পারাপার। রেল পুলিশ জানায়, তার মধ্যে ছিলেন কিশোরবাবুও। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, ট্রেন কাছাকাছি এসে পড়ায় লোকজন চিৎকার করে কিশোরবাবুকে সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু ট্রেনের ধাক্কায় ছিটকে পড়েন তিনি। ডান পায়ের গোড়ালি ছিন্ন করে ট্রেনের চাকা চলে যায়। মাথাতেও আঘাত পান তিনি।

ঘটনাস্থলের পাশেই জমে গিয়েছে ভিড় । বৃহস্পতিবার, রামরাজাতলায়। নিজস্ব চিত্র

ঘটনার পরে ওই লাইন দিয়ে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। লাইনের পাশেই ছটফট করতে থাকেন কিশোরবাবু। কিন্তু এক জনও তাঁকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেননি। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, ওই অবস্থাতেও অনেক ক্ষণ বেঁচে ছিলেন কিশোরবাবু। ঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু হলে হয়তো বেঁচেই যেতেন। কিন্তু অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে কিছু ক্ষণের মধ্যেই মারা যান তিনি।

ওই ঘটনার সময়ে স্টেশনের লেভেল ক্রসিংয়েই দাঁড়িয়ে ছিলেন অরূপ মিত্র নামে এক নিত্যযাত্রী। তিনি বলেন, ‘‘খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। এগিয়ে যাব ভেবেও তাই পিছিয়ে যাই। তা ছাড়া, থানা-পুলিশের একটা ঝামেলাও তো থাকে। এখন বুঝতে পারছি, বড্ড ভুল করে ফেলেছি। আমরা উদ্যোগী হলে ভদ্রলোককে হয়তো বাঁচানো যেত। রেলের অ্যাম্বুল্যান্সও এল অনেক দেরিতে।’’

বাকিরা কেউ এগোলেন না কেন? অরূপবাবুর মতে, ‘‘ওই সময়ে অধিকাংশ যাত্রীই খুব তাড়াহুড়োয় ছিলেন। সেই সঙ্গে পুলিশি ঝামেলার ভয় তো আছেই।’’

রেলের সাহায্য আসতেই বা এত দেরি হল কেন? দক্ষিণ-পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ অফিসার সঞ্জয় ঘোষ বলেন, ‘‘রামরাজাতলা একটি হল্ট স্টেশন। রেলের নিজস্ব কোনও কর্মী সেখানে নেই। কোনও পরিকাঠামোও নেই। দুর্ঘটনা ঘটলে স্থানীয়েরাই সাহায্য করেন। এ দিন অবশ্য কেউ এগিয়ে আসেননি। আমরাই সাঁতরাগাছি স্টেশন থেকে অ্যাম্বুল্যান্স পাঠাই। তাই একটু দেরি হয়েছে।’’

দুর্ঘটনায় পড়া একটি মানুষকে ছটফট করতে দেখেও কেউ সাহায্য করতে না এগোনোয় অবাক হচ্ছেন না মনোরোগ চিকিৎসক প্রদীপ সাহা। তিনি বলেন, ‘‘মানুষ এখন নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। গতির সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে আমরা মারাত্মক রকমের আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছি। তাই চোখের সামনে রাস্তায় পড়ে কেউ মারা গেলেও আমাদের মধ্যে আর প্রতিক্রিয়া তৈরি হয় না। এই প্রবণতা এক ভয়ঙ্কর দিকে যাচ্ছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Accident Train Ramrajatala
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE