অনটনের সঙ্গে লড়েই ওরা সফল। সব প্রতিবন্ধকতাই হার মেনেছে উচ্চ মাধ্যমিকের এই কৃতীদের কাছে।
পরীক্ষার মাস দুয়েক আগে বাবা মারা যান। মনে হয়েছিল, উচ্চ মাধ্যমিকটা দেওয়া হবে তো। কারণ, তখন চিন্তা সংসার কী করে চলবে। আনন্দপুর গার্লসের সেই ছাত্রী রুম্পা বাগ ৪৫০ নম্বর পেয়েছে। বাবা ভোলানাথবাবু সাইকেল মেরামতের কাজ করতেন। মা ছায়াদেবী গৃহবধূ। এক ছেলে আর এক মেয়েকে বড় করতে তিনি চায়ের দোকান খুলেছেন। রুম্পার কথায়, “অনেকে সহযোগিতা করেছেন বলেই পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পেরেছি। নার্সিংয়ে ভর্তির ইচ্ছে আছে। এ বছর হবে না। এখন কেশপুর কলেজে বাংলা অনার্সে ভর্তি হব।”
মৌপাল হাইস্কুলের মৌসুমী কোলে উচ্চ মাধ্যমিকে ৪০৯ নম্বর পেয়েছে। বাবা অচিন্ত্যবাবু চাষবাস করেন। জমি সামান্যই। বছরে দু’বার চাষ হয়, তাই টেনেটুনে চলে যায়। মা সঞ্চিতাদেবী গৃহবধূ। মৌসুমীরা দুই বোন। মৌসুমীই বড়। মেদিনীপুর কলেজে ভুগোল অনার্সে ভর্তি হতে চায়। ভুগোলে প্রাপ্ত নম্বর ৯১। চোখে শিক্ষিকা হওয়ার স্বপ্ন। তবে এই কৃতী ছাত্রী বুঝতে পারছে না, স্বপ্নপূরণ সম্ভব হবে কি না। মৌসুমীর কথায়, “পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভাল নয়। আমি শিক্ষিকা হতে চাই। দরিদ্র ছাত্রছাত্রীদের নিখরচায় পড়াতে চাই। জানি না কতদূর এগোতে পারব।”
অনটনের সংসারে বেড়ে ওঠা ভাদুতলা হাইস্কুলের ছাত্রী জয়া মুখ্যারও। উচ্চ মাধ্যমিকে জয়ার প্রাপ্ত নম্বর ৪০০। বাবা অজিতবাবু ঠিকা- শ্রমিক। লরিতে চিপস্ ওঠানো- নামানোর কাজ করেন। মা সবিতাদেবী গৃহবধূ। জয়ারা এক ভাই, দুই বোন। জয়া বড়। মেদিনীপুর কলেজে ইতিহাস অনার্সে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছে রয়েছে। হতে চায় শিক্ষিকা। কিন্তু উচ্চশিক্ষার পথে দারিদ্র্যতা বাধা হয়ে দাঁড়াবে না তো, দুর্ভাবনার মেঘটা কাটছে না।
মেদিনীপুরের মিশন গার্লসের ছাত্রী সপ্তদীপা রায় উচ্চ মাধ্যমিকে ৪৩০ নম্বর পেয়েছে। চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন দেখে সে। কিন্তু বাধা সেই সংসারের অভাব। বাবা অরুণবাবু ফাস্ট ফুডের দোকানে সস্ সরবরাহ করেন। সামান্যই আয়। মা নমিতাদেবী গৃহবধূ। সপ্তদীপা বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। শনিবার ভেটেরিনারি পরীক্ষা দিয়েছে। আজ, রবিবার বিএসসি নার্সিংয়ের পরীক্ষায় বসবে। জয়েন্টেও বসেছিল। মেদিনীপুরের এই কৃতী ছাত্রী বলছিল, “ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছে আছে। জানি না সেই ইচ্ছেপূরণ হবে কি না।” না হলে বিএসসি নার্সিং বা বায়ো-কেমিস্ট্রি পড়বে। সংসারে অনটন থাকলেও মনে জোর রয়েছে। তার জোরেই এতটা পথটা পেরোনো গিয়েছে। ভাদুতলা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক অমিতেশ চৌধুরী, মৌপাল হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক প্রসূন পড়িয়ারা বলছেন, “দারিদ্র্য কখনও স্বপ্নপূরণে কাঁটা হতে পারে না। ইচ্ছে আর মনের জোর থাকলে স্বপ্নপূরণ সম্ভব। উপায় কিছু না কিছু মিলবেই। এই কৃতী ছাত্রীরা যদি একটু আর্থিক সাহায্য পায়, তাহলে আরও বেশি বিকাশ ঘটাতে পারে। এমন ছাত্রছাত্রীদের আমরাও যতটা পারি, সাহায্য-সহযোগিতা করি।”
স্বপ্নের উড়ানে সওয়ারি হতে চাইছে গরিব ঘরের এই সব কৃতী ছাত্রীরা। স্বপ্নপূরণ যে অনেক দূর। আর আশা, চলার পথে কখনও অসুবিধেয় পড়লে নিশ্চয়ই কোনও সহৃদয়ের হাত তাদের দিকে এগিয়ে আসবে। যে হাতে হাত রেখে আরও অনেকটা পথ পেরোনো যাবে।
— নিজস্ব চিত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy