এখন ফাঁকাই পড়ে থাকে এলাকার বিখ্যাত ডগলাস মাঠ।
খেলা দেখতে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়া তখন ছিল জলভাত। রীতিমতো ২০ পয়সার টিকিট কেটে ফুটবল খেলা দেখতে আসতেন দূর-দূরান্তের বহু মানুষ। বিনা টিকিটে যাতে কেউ খেলা দেখতে না পারে সে জন্য মাঠের চারিদিক চট দিয়ে ঘিরে দেওয়া হত। কমপক্ষে ৫-৬ হাজার লোক খেলা দেখতে মাঠে ভিড় জমাতেন। প্রায় তিন দশক আগের সেই উন্মাদনা আজ অতীত। ‘‘নন্দীগ্রামের ছেলেপুলেরা আর মাঠমুখী হয় না। এক সময় বিকেল হলেই খেলার মাঠ কচিকাঁচাদের কলরবে গমগম করত। আর এখন খেলার মাঠে শুধুই নিস্তব্ধতা’’, বলে চলেন নন্দীগ্রামের প্রাক্তন ফুটবলার সুকুমার পাহাড়ী। আবেহপ্রবণ হয়ে তিনি বলেন, ‘‘মহকুমা ও জেলা স্তরের দলে একসময় নন্দীগ্রামের ছেলেরা দাপিয়ে ফুটবল খেলতেন। সুজস বেরার মতো নন্দীগ্রামের ফুটবলার মোহনবাগানেও খেলেছেন। আজ শুধুই স্মৃতি।’’
সুকুমারবাবুর কথায়, ‘‘নন্দীগ্রামে খেলার ভাল মাঠ নেই। একটি স্কুল মাঠ ও একটি কলেজ মাঠ রয়েছে। যদিও মাঠগুলি খেলার অনুপযুক্ত। খেলাধুলোর পুরনো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে হলে আগে আধুনিক পরিকাঠামো গড়তে হবে।’’ তিনি আরও জানান, ‘‘আগে মাঠে যেতে একটু দেরি হলে খেলার দলে জায়গা পেতাম না। তখন কত খেলোয়াড়। সকলেই একবার মাঠে নামার জন্য উদগ্রীব হয়ে রয়েছে। এখন মাঝে-মধ্যে মাঠে যাই। কাউকে দেখতে পাই না। খুব খারাপ লাগে।’’
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, নন্দীগ্রাম লাগোয়া মানিকপুর গ্রামের বাসিন্দা সুজস বেরা ১৯৭২ সালে মোহনবাগান ক্লাবের জুনিয়র দলে খেলেছেন। তাছাড়াও ১৯৭৮-১৯৮১ সাল পর্যন্ত তিনি ভারতীয় রেলের হয়ে বিভিন্ন খেলায় প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৮১-১৯৮৫ সাল পর্যন্ত মোহনবাগান ক্লাবে ও ১৯৮৬ সালে মহামেডান ক্লাবেও খেলেন তিনি। মানিকপুর গ্রামে প্রাথমিক স্কুল লাগোয়া মাঠে তিনি নিয়মিত খেলতেন। ওই মাঠের একটি অংশে বর্তমানে উচ্চ-প্রাথমিক স্কুলের একটি ভবন তৈরির কাজ চলছে। মানিকপুর দীপায়াতন সঙ্ঘের সম্পাদক সুদীপ্ত বেরা জানান, গ্রামের ছেলেরা দীর্ঘদিন ধরে এই মাঠে খেলাধুলো করে আসছে। মাঠের বেশিরভাগ অংশ স্থানীয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের। ফলে সেই জমিতে নতুন ভবন তৈরির কাজ চলছে। ফলে এখন ছেলেপুলেদের খেলার জায়গা খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর।
সুদীপ্তবাবু আরও জানান, এখন তো ইন্টারনেটের যুগ। মাঠে খেলার থেকে মোবাইলে ভিডিও গেম খেলতেই এখন তরুণ প্রজন্ম অনেক বেশি পছন্দ করে। পাঁচ-ছ’বছর আগেও আমরা অন্যত্র ফুটবল প্রতিযোগিতায় খেলতে গিয়েছি। আজ সে সব কথা গল্প বলে মনে হয়। কলকাতা থেকে মোবাইলে সুজস বেরাও জানান, বর্তমানে শুধু গ্রাম নয়, শহরের ছেলেরা আর মাঠমুখী হয় না। পড়াশোনার চাপ তো রয়েইছে, একইসঙ্গে অল্প বয়স থেকেই তরুণ-তরুণীরা ভাল চাকরি পাওয়ার ইঁদুর দৌড়ে সামিল হয়। ফলে খেলাধুলোর সময় কোথায়।’’ তাঁর কথায়, ‘‘শুধু পড়াশোনা করলেই আদর্শ মানুষ হওয়া যায় না। সে জন্য উন্নত চরিত্র গঠন, দলগত ভাবে কাজ করার অভিজ্ঞতাও থাকা দরকার।’’
১৯৩৩ সালে পথ চলা শুরু নন্দীগ্রামের ডগলাস মেমোরিয়ালে রিক্রিয়েশন ফুটবল ক্লাব-এর। সেই সময় বহু ছেলে ওই ক্লাবে ফুটবল খেলতে আসত। পরে উপযুক্ত খেলার মাঠের অভাব, আর্থিক সমস্যা-সহ নানা কারণে খেলাধুলোর চর্চা ধীরে ধীরে কমে যেতে থাকে। ক্লাবের পরিচালন সমিতির অন্যতম সদস্য সুমন ত্রিপাঠি জানান, ২০০৭ সালে নন্দীগ্রামের জমি আন্দোলন পর্বে খেলাধুলোর চর্চা আরও কমে যেতে থাকে। তখন বাইরে থেকে কোচ এনে ফুটবল প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করা হয়। ২০১০ সালেও ফুটবল প্রতিযোগিতার আয়োজন হয়। তারপর থেকে আর কোনও প্রতিযোগিতা করা যায়নি। খেলাধুলোর মানোন্নয়নের জন্য রাজ্য সরকারের কাছে আর্থিক সাহায্য চেয়েছিলাম। পাইনি। নন্দীগ্রামের বাসিন্দা সুশোভন সেনাপতিও জানালেন, এক সময় নন্দীগ্রামে ভাল ফুটবল খেলা হত। তবে নন্দীগ্রামে আন্দোলন পর্বের পর থেকে খেলাধুলোর চর্চা এক প্রকার উঠে গিয়েছে বলা যায়। নন্দীগ্রাম-১ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি আবু তাহের বলেন, ‘‘নন্দীগ্রামে একটি স্টেডিয়াম তৈরির পাশাপাশি মাঠগুলি সংস্কারের জন্য রাজ্য সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছি।’’ তিনি আরও জানান, মানিকপুরে স্কুলের জমিতেই বাড়ি তৈরি হচ্ছে।
জেলা পরিষদের শিক্ষা, তথ্য সংস্কৃতি ও ক্রীড়া কর্মাধ্যক্ষ মামুদ হোসেন জানান, ‘‘নন্দীগ্রামের ছেলেমেয়েরা খেলাধুলোয় ভাল। নন্দীগ্রামের ক্রীড়ার উন্নয়নের বিষয়টি নিয়ে আমরা চিন্তা করছি।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘নন্দীগ্রামে একটি স্টেডিয়াম তৈরি করাও প্রয়োজন। খেলার মাঠগুলি সংস্কারের পাশাপাশি স্টেডিয়াম তৈরির বিষয়ে জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে রাজ্য সরকারের কাছে আবেদন জানাব।’’ ছবি: আরিফ ইকবাল খান।
কেমন লাগছে আমার শহর? নিজের শহর নিয়ে আরও কিছু বলার থাকলে আমাদের জানান। district@abp.in-এ। subject-এ লিখুন ‘আমার শহর নন্দীগ্রাম’। ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া জানান: www.facebook.com/anandabazar.abp অথবা চিঠি পাঠান ‘আমার শহর’, পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর বিভাগ, জেলা দফতর, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০০০১ ঠিকানায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy