Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

চিতায় দেহ উঠলেই ছুটির ঘণ্টা স্কুলে

ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক সবাই উপস্থিত। ক্লাসও চলছে দিব্যি। হঠাৎ ছন্দপতন। পাশের মাঠে একে একে জড়ো হচ্ছে লোকজন। রব উঠছে ‘বল হরি, হরি বোল’। এরপর কী ঘটবে সকলেরই জানা।

স্কুল ও শ্মশানের মাঝে নেই সীমানা প্রাচীর। ছবি: আরিফ ইকবাল খান।

স্কুল ও শ্মশানের মাঝে নেই সীমানা প্রাচীর। ছবি: আরিফ ইকবাল খান।

সামসুদ্দিন বিশ্বাস
সুতাহাটা শেষ আপডেট: ০২ অগস্ট ২০১৫ ০১:৩৩
Share: Save:

ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক সবাই উপস্থিত। ক্লাসও চলছে দিব্যি। হঠাৎ ছন্দপতন। পাশের মাঠে একে একে জড়ো হচ্ছে লোকজন। রব উঠছে ‘বল হরি, হরি বোল’। এরপর কী ঘটবে সকলেরই জানা। তাই বইখাতা গুটিয়ে তড়িঘড়ি বাড়ির পথে পা বাড়ায় পড়ুয়ারা।

একেবারে স্কুল লাগোয়া শ্মশানে শবদেহ এলেই ছুটি হয়ে যায় পূর্ব মেদিনীপুরের সুতাহাটা চৈতন্যপুরের রঘুনাথপুর প্রাথমিক ও উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়। বছরের পর এখানে এটাই নিয়ম। স্কুল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, শ্মশানের এমন অবস্থান যে ছুটি না দেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। স্কুল ও শ্মশানের মধ্যে কোনও পাঁচিল নেই। তাই কাঠের চিতায় সৎকার শুরু হতেই ধোঁয়া ক্লাসঘরে ঢোকে। বাইরে তাকালেই চোখে পড়ে শেষকৃত্যের যাবতীয় প্রথা। প্রাথমিক স্কুলের শিশুদের তখন আর ক্লাসে বসিয়ে রাখা যায় না। অগত্যা ছুটির ঘণ্টা বাজিয়ে দেওয়া হয়।

রঘুনাথপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্ম ১৯১০ সালে। ২০১২ সালে লাগোয়া জমিতে পৃথক ভবনে শুরু হয়েছে রঘুনাথপুর উচ্চ প্রাথমিক স্কুল। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দেবাশিস দাস ২১ বছরের অভিজ্ঞতায় বহুবার এই কারণে স্কুল ছুটি দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘সৎকারের পুরো প্রক্রিয়া স্কুল থেকে দেখা যায়। ছাত্রছাত্রীরা সে সব দেখে ভয় পায়। তা ছাড়া চিতার ধোঁয়া, মৃতদেহ পোড়ার গন্ধ স্কুলের ভেতরে ঢুকে পড়াটা তো মোটেই স্বাস্থ্যকর নয়।’’ তা ছাড়া, শ্মশান লাগোয়া যে পুকুরে সৎকারের পরে জিনিসপত্র ফেলা হয়, শ্মশানযাত্রীরা স্নান করেন, সেটিও স্কুল চত্বরের মধ্যেই। পুকুরের সিঁড়ি একেবারের স্কুলের দরজা পর্যন্ত উঠে গিয়েছে। স্কুলে সাব মার্সিবল পাম্প রয়েছে। সেই জলেই যাবতীয় কাজ হয়। কিন্তু বিদ্যুৎ না থাকলে ওই পুকুরের জলেই হাত-পা পরিষ্কার করে ছাত্র-শিক্ষকরা। ফলে, স্বাস্থ্য নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।

স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, শ্মশানটি প্রায় দেড়শো বছরের পুরনো। পরে তার লাগোয়া জমি স্কুল তৈরি হয়। এক কিলোমিটারের মধ্যে আরও একটি শ্মশান রয়েছে। কিন্তু স্থানীয় রঘুনাথপুর, বিজয়রামপুর ও রামচন্দ্রপুর— এই তিনটি গ্রামের মানুষ এই শ্মশানটিই ব্যবহার করেন। বছরে গড়ে সাত থেকে আটটি দেহ সৎকার হয় এখানে। চলতি জুলাই মাসেই যেমন দু’টি শবদেহের সৎকার হয়েছে। দু’দিনই ছুটি দিতে হয়েছে স্কুল। ২০১২ সালে তো সরস্বতী পুজোর দিনেও একই কারণে স্কুল ছুটি দিতে হয়েছিল। পুজোটাও আর হয়নি।

প্রবীণা নন্দিতা বেরা ২৯ বছর ধরে শিক্ষকতা করছেন রঘুনাথপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তিনি বলেন, ‘‘স্কুল লাগোয়া পুকুরটিকে অনেকে মড়া-পুকুর নামে ডাকেন। মৃতদেহ সৎকার শুরু হলে স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা আতঙ্কে ছোটাছুটি করতে থাকে। এর একটা সুস্থ সমাধান দরকার।’’ চতুর্থ শ্রেণির পড়ুয়া বীরেন, অনন্যারা বলে, ‘‘জানলা দিয়ে দেখা যায় মৃতদেহ। আমাদের খুব ভয় করে। তখন আর ক্লাস হয় না। আমরা বাড়ি চলে যাই।’’ রঘুনাথপুর উচ্চ প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক সুরজিৎ গুছাইত জানালেন, এই সমস্যা সমাধানের জন্য প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে দরবার করা হয়েছে। কিন্তু কাজ হয়নি।

জানা গিয়েছে, স্থানীয় প্রামাণিক পরিবার ও আরও কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দার দানের জমিতেই গড়ে উঠেছে শ্মশান এবং স্কুল। তবে সরকারি নথিতে শ্মশান হিসাবে ওই স্থানের কোনও উল্লেখ নেই। তাহলে তো শ্মশান সরিয়ে অন্যত্র নিয়ে যাওয়াই যায়! শ্মশান উন্নয়ন কমিটির সম্পাদক চিত্তরঞ্জন প্রামাণিক যদিও বলেন, ‘‘ঘুনাথপুর, বিজয়রামপুর ও রামচন্দ্রপুর গ্রামের লোকজন বংশপরম্পরায় এখানেই দাহকাজ করেন। এর সঙ্গে তিন গ্রামের আবেগ জড়িয়ে আছে।’’ গত ১৪ জুলাই চিত্তরঞ্জনবাবুর মায়ের মৃত্যুর পরেও তাই এই শ্মশানেই দেহ সৎকার হয়েছিল। তারপর গত শনিবার এক গৃহবধূর দাহকাজ হয়।

সমস্যা সমাধানে তাহলে উপায়?

সুতাহাটার চৈতন্যপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান শ্রীবাস মাইতি বলেন, ‘‘ওখানে অনেক দিন ধরে শ্মশান রয়েছে। পঞ্চায়েতই শ্মশান যাত্রীদের বসার জায়গাও করে দিয়েছে। এলাকার লোকজন প্রাচীর তৈরির দাবি জানিয়েছেন। বিষয়টি দেখা হচ্ছে।’’ বিষয়টি নজরে এসেছে পূর্ব মেদিনীপুর জেলা পরিষদের শিক্ষা কর্মাধ্যক্ষ মামুদ হোসেনেরও। তাঁর আশ্বাস, ‘‘জেলাশাসক, জেলা স্কুল পরিদর্শক ও স্থানীয় প্রশাসনকে নিয়ে আলোচনা করে শীঘ্রই ওই সমস্যার সমাধান করা হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE