ইংরেজ জমিদারি কোম্পানির এই কাছারিবাড়িই এখন বেলপাহাড়ির বিডিও অফিস। ছবি: দেবরাজ ঘোষ।
জঙ্গল আর পাহাড়ের স্নিগ্ধ শান্ত পরিবেশে পশ্চিমের এই বনাঞ্চলের জুড়ি নেই। স্বাস্থ্যকর জলবায়ুতে হাওয়া বদলের জন্য ষাট-সত্তরের দশকে ভিড় জমাতেন বাঙালি। ওই সময়ে বাংলা চলচ্চিত্রের বিভিন্ন দৃশ্যেও দেখা যেত বেলপাহাড়িকে।
ষাটের দশকে উত্তমকুমারের ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’, সত্তরের দশকে টেনিদার কাহিনী নিয়ে ‘চারমূর্তি’ কিংবা আশির দশকে ‘বেহুলা লখিন্দর’ ছবির একাধিক দৃশ্যের শ্যুটিং হয়েছিল বেলপাহাড়ির আশেপাশের এলাকায়। স্থানীয় বন বাংলোগুলিতে বছর ভর আনাগোনা ছিল পর্যটকের। শীতের মরসুমে ঠাঁই পাওয়া মুশকিল হত।
কিন্তু নব্বইয়ের দশকের শেষ ভাগে পাহাড়-জঙ্গলের আবডালে চরমপন্থী বিপ্লবী কার্যকলাপ দানা বাঁধতে শুরু করে। ২০০৪ সালে দলদলির জঙ্গলপথে মাইন ফাটিয়ে পুলিশের গাড়ি উড়িয়ে দেয় নকশালপন্থী জনযুদ্ধ গোষ্ঠী। মৃত্যু হয় সাত পুলিশ কর্মী ও চালকের। ওই বছরই সেপ্টেম্বরে দু’টি নকশালপন্থী সংগঠন এমসিসি এবং জনযুদ্ধ মিশে গিয়ে গঠিত হয় সিপিআই (মাওবাদী)। আর তার পর থেকে শুরু হয়ে যায় খুন-নাশকতার ধারাবাহিক রক্তাক্ত অধ্যায়। কাঁকড়াঝোরে বন দফতরের দু’টি বন বাংলো ধ্বংস করে দেয় মাওবাদীরা। ভর সন্ধ্যায় জনবহুল বেলপাহাড়ি বাজার খুন হন এক সিপিএম নেতা। এমন সব ঘটনার জেরে প্রায় বছর দশেক পর্যটকশূন্য হয়ে যায় বেলপাহাড়ি।
সে সব রক্তাক্ত সন্ত্রাসের দিন এখন অবশ্য অতীত। জঙ্গলমহলের পর্যটন প্রসারে উদ্যোগী হয়েছে রাজ্য সরকার। কিন্তু বেলপাহাড়ির খাসতালুকটি ব্রাত্যই রয়ে গিয়েছে।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বেলপাহাড়ির বিভিন্ন এলাকায় পর্যটকদের আনাগোনা বেড়েছে। কিন্তু এখনও গড়ে উঠেনি রাত্রিবাসের উপযুক্ত লজ বা হোটেল। এমনকী সারাদিন খাওয়ার জন্যও রয়েছে হাতেগোনা কয়েকটি হোটেল। সরকারি উদ্যোগে ঝাড়গ্রামে পর্যটকদের থাকার জন্য প্রকৃতি পর্যটন কেন্দ্র তৈরি হয়েছে। অথচ, বেলপাহাড়ি ব্লক সদরে পর্যটন পরিকাঠামো বলতে কিছুই নেই।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, পর্যটকরা এখানে রাত্রিযাপন করলে এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্যের উপর সরাসরি তার প্রভাব পড়ত। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি বেলপাহাড়িতে দেখার মতো অনেক কিছুই রয়েছে। ইংরেজ জমিদারি কোম্পানির কাছারি বাড়ি ও ইংরেজ জমিদারের বাংলো, নীলকুঠির ধ্বংসাবশেষ।
কাছারি বাড়িটিকে ব্লক কার্যালয়ে রূপান্তরিত করা হয়েছে। পুরনো বাংলোটি বিডিও-র আবাসন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সংস্কার করার পর দু’টি ভবনই যথেষ্ট আকর্ষণীয়। এ ছাড়া কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে রয়েছে ঘাঘরা, তারাফেনি, লালজল, কাঁকড়াঝোর, কেতকিঝর্ণা, খাঁদারানির মতো অসাধারণ সব দ্রষ্টব্য জায়গা।
কিন্তু থাকার জায়গা নেই বলে পর্যটকরা ঝাড়গ্রামে থাকেন। সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে বেলপাহাড়িতে এসে ঘুরে যান ঘণ্টা কয়েক। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ এতে বেলপাহাড়ির উন্নয়ন আটকে যাচ্ছে।
ধরা যাক গাড়ির ব্যবসার কথা। খাস বেলপাহাড়িতেই রয়েছে প্রায় ১০০টি ভাড়ার গাড়ি। কিন্তু তারা যাত্রী পায় না। কেমন করেই বা পাবে? যে সব পর্যটক আসেন, তাঁরা ঝাড়গ্রাম থেকেই গাড়ি ভাড়া করে নিয়ে আসেন। বেলপাহাড়ির ভাড়ার গাড়ির মালিক মেহতাব আজম, বাপি পণ্ডিত বা গাড়ি চালক অমিত শীট, আশিস মাহাতোদের অভিযোগ অশান্তি মিটে গেলে পর্যটকদের আনাগোনা শুরু হয়েছে। কিন্তু স্থানীয়দের কপাল খোলেনি। অমিত শীট বলেন, ‘‘ঝাড়গ্রাম থেকে হাজার হাজার টাকা গাড়ি ভাড়া দিয়ে পর্যটকরা কয়েক ঘণ্টার জন্য এলাকার আসেন। কিন্তু পর্যটকরা এখানে থাকলে আমাদের গাড়িতে কম ভাড়ায় ঘুরতে পারতেন। সুবিধা হত দু’তরফেরই।’’
ব্যবসায়ীদের একাংশের বক্তব্য, বেলপাহাড়িতে আগে একটি লজ ছিল। মাওবাদী অশান্তি পর্বে সেটি বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু এখনও এখানে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করার ঝুঁকি নিতে চান না কেউ। বেলপাহাড়ি পঞ্চায়েত সমিতির বিরোধী কংগ্রেস সদস্য সুব্রত ভট্টাচার্য বলেন, “সরকারি খরচে অতিথিশালা তৈরি করে সে গুলি বেসরকারি হাতে পরিচালনার ভার দেওয়া হলে স্থানীয় ভাবে অনেক কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হত। এলাকার গরিব মানুষরা উপকৃত হতেন।’’
সরকারি স্তরে অবশ্য ব্লক অফিস চত্বরে পুরনো একটি ভবনের দোতলায় তিনটি ঘরে পর্যটক থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু সে গুলি থাকার অযোগ্য বলে অভিযোগ করেন বাসিন্দারাই। অন্যদিকে, বেলপাহাড়ির বন বাংলোয় রয়েছে মাত্র দু’টি ঘর। সব সময় বুকিংও মেলে না।
বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক দেওয়ানচাঁদ সরেন বলেন, “উন্নয়নের নামে সরকারি অফিস ও প্রাঙ্গণ ঢেলে সাজানো হচ্ছে। অথচ বেলপাহাড়ির খাসতালুকে পর্যটন প্রসারে তেমন উদ্যোগ চোখে পড়ছে না।”
বেলপাহাড়ি পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি বংশীবদন মাহাতো বলেন, “লজ-হোটেল না থাকার সমস্যাটি আমরাও অনুভব করেছি। বেলপাহাড়িতে অতিথিশালা তৈরি করার জন্য পঞ্চায়েত সমিতির পক্ষ থেকে শীঘ্রই উদ্যোগ নেওয়া হবে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy