Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

প্রতিরোধই পথ, মানছে বাম শিবির

বহিরাগত রুখতে খড়্গপুর-১ ব্লকের বড়কোলা পঞ্চায়েতের নায়েকপাড়া কেন্দ্রে উপ-নির্বাচনে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন বাম প্রমীলা বাহিনী। নায়েকপাড়া আসন দখলে রাখতে পেরেছে বামেরা। এমনকী ব্লকের গোপালী পঞ্চায়েতের মীরপুর আসনও তৃণমূলের থেকে বামেরা ছিনিয়ে নিয়েছে।

জয়ের খবর আসার পর নারায়ণগড়ে তৃণমূলের মিছিল। বুধবার।

জয়ের খবর আসার পর নারায়ণগড়ে তৃণমূলের মিছিল। বুধবার।

নিজস্ব সংবাদদাতা
মেদিনীপুর ও খড়্গপুর শেষ আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০১৫ ০১:৫২
Share: Save:

বহিরাগত রুখতে খড়্গপুর-১ ব্লকের বড়কোলা পঞ্চায়েতের নায়েকপাড়া কেন্দ্রে উপ-নির্বাচনে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন বাম প্রমীলা বাহিনী। নায়েকপাড়া আসন দখলে রাখতে পেরেছে বামেরা। এমনকী ব্লকের গোপালী পঞ্চায়েতের মীরপুর আসনও তৃণমূলের থেকে বামেরা ছিনিয়ে নিয়েছে। যদিও রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রর বিধানসভা কেন্দ্র নারায়ণগড়ে পাঁচটি গ্রাম পঞ্চায়েত ও একটি পঞ্চায়েত সমিতির আসনই হাতছাড়া হল বামেদের। বামেদের অভিযোগ, তৃণমূলের অবাধ সন্ত্রাসের কারমেই সাধারণ মানুষ ভোট দিতে পারেননি। তার জেরেই এই পরাজয়। নিজেদের দুর্বলতা ঢাকতেই বামেরা ভিত্তিহীন অভিযোগ করছে বলে পাল্টা দাবি ঘাসফুল শিবিরের।

পশ্চিম মেদিনীপুরে সবমিলিয়ে ৩০টি আসনে উপ-নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। নির্বাচন হয় অবশ্য ২২টি আসনে। কারণ, বাকি ৮টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় নিশ্চিত করে নেয় শাসক দল। এই ২২টি আসনের মধ্যে ১৯টি গ্রাম পঞ্চায়েতের। ৩টি পঞ্চায়েত সমিতির। বুধবার ভোটের ফল বেরনোর পর দেখা যায়, ৩টি পঞ্চায়েত সমিতির সবগুলোই তৃণমূলের দখলে গিয়েছে। ১৯টি গ্রাম পঞ্চায়েতের ১৬টি তৃণমূলের দখলে গিয়েছে। ১টি করে আসন পেয়েছে সিপিএম, সিপিআই এবং নির্দল। সিপিএম যে আসনটি পেয়েছে, সেটি আগে তৃণমূলের দখলে ছিল।

খড়্গপুর মহকুমার নারায়ণগড়, খড়্গপুর-১, খড়্গপুর-২, ডেবরা ব্লকের ১২টি গ্রাম পঞ্চায়েত ও ১টি পঞ্চায়েত সমিতির আসনে বুধবার ছিল ভোট গণনা। গ্রাম পঞ্চায়েতগুলির মধ্যে খড়্গপুর-১ ব্লকের বড়কোলা পঞ্চায়েতের নায়েকপাড়া, গোপালী পঞ্চায়েতের মীরপুর, খড়্গপুর-২ ব্লকের পলসা পঞ্চায়েতের জামিরা, নারায়ণগড়ের কুনারপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের কুসদা, সরিষা, সাঁইবনি, নন্দকিশোরপুর, বাকিবাজার, খুড়শি গ্রাম পঞ্চায়েতের গোপীনাথপুর, ডেবরা ব্লকের মলিহাটি পঞ্চায়েতের চকমাধুরী, লোয়াদা পঞ্চায়েতের শিবরামপুর, রাধামোহনপুর-১ পঞ্চায়েতের আষাঢ়ি আসনে গত শনিবার ভোটগ্রহণ হয়। নারায়ণগড় ব্লকের সবক’টি, বড়কোলার নায়েক পাড়া, ডেবরার আষাঢ়ি আসনগুলি বামেদের দখলে ছিল। তৃণমূলের দখলে ছিল মীরপুর, জামিরা, চকমাধুরী আসন। শিবরামপুর আসনের এক প্রার্থীর মৃত্যুর জেরে বাতিল হয়ে যায় ভোটগ্রহণ। নারায়ণগড়ের কুনারপুরের নন্দকিশোরপুর পঞ্চায়েত সমিতির নির্বাচিত বাম প্রতিনিধি পদত্যাগ করায় আসনটি শূন্য হয়। ওই আসনেও এ দিন ভোটগণনা হয়। মহকুমার ১০টি পঞ্চায়েত ও ১টি পঞ্চায়েত সমিতির আসনেই জয় পেয়েছে তৃণমূল। একমাত্র নায়েকপুর ও মীরপুর আসনে জয়ী হন বাম প্রার্থীরা।

নির্বাচনে বামেদের এমন বিপর্য়য়ের কারণ কী?

বামেদের দাবি, রাজ্যে তৃণমূল এখন কোণঠাসা। ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষ বামেদের সমর্থন করছিলেন। যদিও তৃণমূলের সন্ত্রাসে প্রকাশ্যে বামেদের মিটিং-মিছিলে যেতে ভয় পাচ্ছে মানুষ। ভোটেও প্রশাসনের মদতেও যে ভাবে তৃণমূল সন্ত্রাস চালিয়েছে, তার জেরেই এই পরাজয়। ২০১৩ সালের নন্দকিশোরপুরের পঞ্চায়েত সমিতির আসনে জয়ী হয়েছিলেন আসরাইল আলি। পরে পদত্যাগ করেন তিনি। উপ-নির্বাচনে ওই আসনে তাঁকেই প্রার্থী করেছিল সিপিএম। পদত্যাগের কারণ কী? আসরাইল আলির কথায়, “গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের ২২দিনের মাথায় তৃণমূল যে ভাবে বাড়ি ভাঙচুরের হুমকি দিয়েছিল তাতে বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করেছিলাম।’’ তাঁর অভিযোগ, ‘‘এ বার ভোটের আগের দিন থেকে তৃণমূলের সশস্ত্র বাহিনী যে ভাবে সন্ত্রাস চালিয়েছে তাতে মানুষ ভোট দিতে যায়নি। ওঁরা নিজেদের মতো ছাপ্পা দিয়েছে।”

জয়ী খড়্গপুরের মীরপুরের বাম প্রার্থী।

বাম প্রমীলা বাহিনীর প্রতিরোধের জেরেই যে নায়েকপাড়া ও মীরপুর আসন বামেদের দখলে এসেছে, তা মানছেন দলীয় নেতৃত্ব। সিপিআইয়ের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সহ-সম্পাদক বিপ্লব ভট্ট বলেন, “গ্রামের মহিলারা যে ভাবে তৃণমূলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন সেটা আমাদের জয়ের অন্যতম কারণ।” একইভাবে, সিপিএমের জোনাল সম্পাদক কমল পলমলের বক্তব্য, “ওই দুই পঞ্চায়েতে প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ধারাবাহিক উন্নয়ন ও তৃণমূলের বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিরোধের কারণেই জয় এসেছে।” প্রশ্ন উঠছে, খড়্গপুর মহকুমার অন্যত্র কেন প্রতিরোধের এই ছবি দেখা গেল না? সিপিএমের নারায়ণগড় জোনাল সম্পাদক মদন বসু বলেন, “একটা সাংগঠনিক দুর্বলতা যে রয়েছে সেটা অস্বীকার করে লাভ নেই। কিন্তু সেই দুর্বলতা অনেক কেটে গিয়েছিল। তৃণমূলের সন্ত্রাসের জেরে মানুষ ভোট না দিতে পারায় নিজেদের মতো করে প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে ভোট করেছে তৃণমূল। সেই কারণেই এই পরাজয়।” অভিযোগ অস্বীকার করে তৃণমূলের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা কার্যকরী সভাপতি নির্মল ঘোষ বলেন, “খড়্গপুর-১ ব্লকে সিপিএমের সংগঠন যে মজবুত, তা প্রমাণিত। তবে নারায়ণগড়ে সূর্যকান্ত মিশ্রর পায়ের তলায় মাটি যে সরে গিয়েছে সেটা সিপিএম এখনও মেনে পারেনি। তাই এইসব ভিত্তিহীন অভিযোগ করছে।”

এ দিন পঞ্চায়েতে হারের কারণ নিয়ে সিপিএমের ডেবরা জোনাল সম্পাদক প্রাণকৃষ্ণ মণ্ডল বলেন, “কিছু স্থানীয় বিষয় কাজ করেছে। শাসকদল প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দিয়েছে।’’ ভোটের মুখে আষাঢ়িতে একটি গভীর নলকূপ খনন করায় সেখানকার মানুষ শাসকদলকে ভোট দিয়েছে বলে তাঁর দাবি। সেই সঙ্গে সর্বত্র সন্ত্রাস চলেছে। তৃণমূলের ডেবরা ব্লক সভাপতি রতন দে অবশ্য বলেন, “কী ভাবে উন্নয়ন করতে হয় আমরা তা তুলে ধরেছি। হ্যাঁ নলকূপ হয়েছে, রাস্তা হয়েছে। তাই মানুষ দু’হাত ভরে ভোট দিয়েছে।” তৃণমূলের জেলা কার্যকরী সভাপতি অজিত মাইতি বলেন, “বাংলা জুড়ে যে উন্নয়নের কর্মযজ্ঞ চলছে দল পরিচালিত জেলা পরিষদ, পঞ্চায়েত সমিতি, পঞ্চায়েতগুলিও তার অংশীদার। মানুষ সব বিচার করেই ভোট দিয়েছে।”

১৯টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে মাত্র ২টি আসন বামেদের দখলে এসেছে। এর কারণ হিসেবে জেলা সিপিএমের এক নেতার যুক্তি, “নির্বাচন কোথায় হল? নির্বাচন তো হয়নি! নির্বাচনের নামে প্রহসন হয়েছে।” তাঁর কথায়, “নির্বাচনে প্রার্থী দেওয়াটাই যেখানে চ্যালেঞ্জের, সেখানে প্রার্থী দিয়ে সেই প্রার্থীকে জিতিয়ে আনা আরও বড় চ্যালেঞ্জের। প্রথম থেকেই আমরা খুব আশঙ্কার মধ্যে ছিলাম। আমাদের ১০টি আসনে প্রার্থী দিতে দেওয়া হয়নি। জোর করে প্রার্থীপদ প্রত্যাহারও করানো হয়েছে। আমরা চেয়েছিলাম, নির্বাচনে মানুষ নিজের ভোটটা দিক। মানুষ যাতে নিশ্চিন্তে ভোটটা দিতে পারে, পুলিশ- প্রশাসন সেই ব্যবস্থা করুক। তা হল না।” বিজেপির জেলা সভাপতি তুষার মুখোপাধ্যায়ও বলেন, “এই নির্বাচনটা প্রহসনের নির্বাচন ছিল। তৃণমূলের বহিরাগতরা বুথে বুথে দাপিয়ে বেড়িয়েছে।” জবাবে তৃণমূলের জেলা সভাপতি দীনেনবাবু বলেন, “মানুষ ওদের সঙ্গে নেই। তাই এ সব কথা বলা হচ্ছে। উপ- নির্বাচনে সিপিএমের ভোট প্রচুর কমেছে। তৃণমূলের ভোট অনেক অনেক বেড়েছে। এই জয় মানুষের জয়।”

যদিও পঞ্চায়েতের উপ- নির্বাচনের জেলাওয়াড়ি ফলাফলে একেবারে অখুশি নয় বামেরা। তৃণমূল তাদের খালি হাতে ফেরাতে মরিয়া ছিল। খালি হাতে অবশ্য ফিরতে হয়নি। কয়েকটি এলাকায় লড়াইও হয়েছে। এতেই খুশি বাম- শিবির। সিপিএমের জেলা সম্পাদক তরুণ রায় বলেন, “যেখানে মানুষ ভোট দেওয়ার সুযোগ পেয়েছে, সেখানে মানুষ আমাদের সমর্থন করেছেন। যেখানে প্রতিরোধ করা যায়নি, সেখানে ফলাফল অপেক্ষাকৃত খারাপ হয়েছে। আমরা আশা করেছিলাম, ফলাফল এ রকমটাই হবে। কারণ, অনেকগুলো জায়গায় তো আমাদের মনোনয়ন দিতে দেওয়া হয়নি।”

সিপিআইয়ের জেলা সম্পাদক সন্তোষ রাণারও বক্তব্য, “যেখানে মানুষ তৃণমূলের বহিরাগতদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন, সেখানে বামেদের ফল তুলনায় ভাল হয়েছে।” উপ- নির্বাচনে সার্বিক ফল তৃণমূলের বিরুদ্ধেই গিয়েছে বলে দাবি বাম- শিবিরের। বামেদের দাবি অবশ্য উড়িয়ে দিয়েছে তৃণমূল। তৃণমূলের জেলা সভাপতি দীনেন রায়ের কথায়, “উপ- নির্বাচনের ফলাফলে আরও একবার প্রমাণ হল মানুষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেই আছেন। সিপিএমের প্রভাব ক্রমে কমছে। মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েই ওরা কুত্‌সা- অপপ্রচার করে।”

— নিজস্ব চিত্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE