চলছে বর্জ্য পদার্থ সংগ্রহের কাজ। —নিজস্ব চিত্র।
সব্জির খোসা, উচ্ছিষ্ট খাবার, কাটা ঘাস, কাগজ, প্ল্যাস্টিকের মতো জিনিস দিয়ে জৈব সার-গ্যাস, পেট্রোল-ডিজেল তৈরিতে উদ্যোগী হল খড়্গপুর আইআইটি। প্রাথমিক ভাবে জৈব সার এবং গ্যাস তৈরিতে সাফল্য মিলেছে বলে দাবি আইআইটির গবেষক-পড়ুয়াদের। গবেষণার প্রয়োজনে তাঁরা আইআইটি ক্যাম্পাসের অদূরে এক একর জমি লিজে নিয়ে প্রায় এক বছর ধরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছে।
বর্জ্য পদার্থ থেকে সার বা গ্যাস তৈরির পদ্ধতি নতুন নয়। খড়, কচুরি পানা পচিয়ে কিংবা গোবর থেকে গ্যাস তারপর উপজাত অংশ থেকে সার তৈরি করা হয়। সাধারণত দেখা যায়, চিরাচরিত এই পদ্ধতিতে বিশেষ প্রযুক্তি থাকে না। কিন্তু, আইআইটি আবিষ্কৃৃত পদ্ধতিটি সম্পূর্ণ আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর বলে দাবি গবেষক দলের। চলতি বছরের এপ্রিল থেকেই জৈব সার ও গ্যাস উৎপাদন শুরু হয়েছে। তাদের সার গুণগত ভাবে অনেক বেশি ভাল বলে মত গবেষকদের। কেন? গবেষক দলের তরফে অভিমন্যু করের ব্যাখ্যা, “মিথেন গ্যাস উৎপাদন সাধারণত ‘অ্যানারোবিক’ পদ্ধতিতে হয়। তাতে গ্যাস তৈরির পর অবশিষ্ট সারে অ্যাসিড বা অম্ল থেকে যায়। কিন্তু, আমরা তা কাটাতে ‘অ্যানারোবিক’ পদ্ধতির সঙ্গে সঙ্গেই ‘এয়ারোবিক’ পদ্ধতি ব্যবহার করছি। যা নতুন।”
ইতিমধ্যেই ওই গবেষক দল ‘গেইন ওয়েস্ট সলিউশন প্রাইভেট লিমিটেড’ নামে একটি ‘মডেল’ সংস্থা তৈরি করেছে। তাতে অনুমতি রয়েছে আইআইটি কর্তৃপক্ষের। তবে, এই সংস্থা খোলার পথ খুব মসৃণ হয়নি। প্রথম পর্যায়ে ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ হিউম্যান সেটেলমেন্ট’ নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সহযোগিতা করে। ২০১২ সালে বেঙ্গালুরুতে ওই প্রতিষ্ঠান আয়োজিত ‘নগরের সমস্যা’ শীর্ষক আলোচনায় রানার্স হয় আইআইটির এই দলটি। নাগরিক সমস্যা তুলে ধরে তাঁর সমাধান নিয়েই ছিল এই প্রতিযোগিতার মুখ্য বিষয়। সেখানে আইআইটি-র দলটি ‘কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থা পদ্ধতি’র প্রযুক্তি তুলে ধরে। তাতে মিলেছিল ২০ হাজার টাকার আর্থিক পুরস্কার। শর্ত ছিল, ওই প্রযুক্তি ব্যবহার করে একটি সামাজিক সংস্থা খুললে প্রকল্পে প্রাথমিক পর্যায়ে ৩ লক্ষ টাকা দেওয়া হবে। সেই মতো প্রতিষ্ঠিত হয় গেইন ওয়েস্ট সলিউশন প্রাইভেট লিমিটেড।
কেন এই ধরনের প্রকল্প? সংস্থার অন্যতম কর্ণধার আইআইটি-র মেকানিক্যাল বিভাগের গবেষক-ছাত্র অভিমন্যুর কথায়, “কয়েক বছর আগে কোরিয়া, মালেশিয়া ঘুরতে গিয়েছিলাম। সেই সময়ই ওদের সঙ্গে আমাদের দেশের পার্থক্যটা টের পাই। ওখানে পরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাট। আর এখানে রাস্তাঘাটে, আনাচ-কানাচে ছড়িয়ে থাকে আবর্জনা।” তারপর থেকেই পরিষ্কার পরিবেশ গড়তে এই পদ্ধতি মাথায় আসে। তা হাতেকলমে প্রয়োগের সুযোগ মেলে ওই প্রতিযোগিতায়। তারপর আইআইটি-র আইন বিভাগের পড়ুয়া অনন্যা রায়, বিশ্বরূপ ঘোষ, বি টেকের ছাত্র বিশ্বজিৎ মণ্ডলকে নিয়ে শুরু যাত্রা। আইআইটি-র নিয়ন্ত্রিত ‘স্টেপ’ নামক একটি সংস্থার থেকে শহর থেকে অদূরে গোপালীতে ১ একর জমি বছরে ২৪ হাজার টাকার বিনিময়ে লিজে নেয় তাঁরা। স্থানীয় কিছু শ্রমিকও বর্জ্য সংগ্রহের কাজ করছেন এই প্রকল্পে।
সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে আইআইটিও। ‘গ্রিন ইনিশিয়েটিভ প্রজেক্টে’ এই পড়ুয়াদের দিয়েই সাতটি হোস্টেলের আবর্জনা মুক্ত করার টেন্ডার দিয়েছেন তাঁরা। ওই বর্জ্য জলীয় ও শুষ্ক এই দুটি ভাগে আলাদা করে গোপালীর প্রকল্প এলাকায় ফেলা হচ্ছে। তা থেকে তৈরি হচ্ছে জৈব সার। ‘গ্রিন ইনিশিয়েটিভ প্রজেক্টে’র আইআইটির অধ্যাপক সদস্য নিশীথরঞ্জন মণ্ডল বলেন, ‘‘দূষণ কমাতে বর্জ্যের পুনর্ব্যবহার জরুরি। তা থেকে একটা আয়েরও সুযোগ রয়েছে।” পড়ুয়াদের উদ্যোগের প্রশংসা করে তিনি বলেন, “এই মডেল বেকার যুবকরা শিখে নিজেরাই এই ধরনের প্রকল্প করতে পারবে।”
জৈব সার বা গ্যাস ছাড়াও জঞ্জাল থেকে ডিজেল ও পেট্রল উৎপাদনের ভাবনাও রয়েছে আইআইটির গবেষকদের। প্রকল্পে আর্থিক সহযোগিতার জন্য গবেষক দলের তরফে ‘গ্রিন ইনিশিয়েটিভ প্রজেক্টে’ ১০ লক্ষ টাকা চাওয়া হয়েছে। অভিমন্যু বলেন, “প্লাস্টিক পেট্রোলিয়াম পদার্থ, তাই তা থেকে ৯০ ভাগ পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। দেশের কোথাও এখনও পর্যন্ত এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে ডিজেল তৈরি হয় না।”
ইতিমধ্যেই প্রথম দফার উৎপাদিত সার অধ্যাপকদের বাড়ির বাগানের জন্য বিক্রি হয়েছে। সারা মিলেছে অন্য জেলা থেকেও। সংস্থার সদস্য বিটেকের পড়ুয়া বিশ্বজিৎ মণ্ডল বলেন, “আমাদের লক্ষ্য সমাজ থেকে আবর্জনা মুক্ত করে আয়ের উৎস খোঁজা। দলের তরফে পূর্ব মেদিনীপুরের এক কর্মাধ্যক্ষের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। উনি আগ্রহ দেখিয়েছেন।” আগ্রহী পূর্বের কৃষি-সেচ-সমবায় কর্মাধ্যক্ষ বুদ্ধদেব ভৌমিকও। তিনি বলেন, “জেলা পরিষদে ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্টের কিছু টাকা রয়েছে। আইআইটি-র পড়ুয়াদের প্রযুক্তি শিখে চাষিরা জৈব গ্যাস তৈরি করে বেশি মুনাফা করতে পারলে ভাল হবে।”
আইআইটি পড়ুয়াদের এই চেষ্টায়, দেশের জঞ্জাল সত্যিই মুক্ত হয় কিনা, দেখার সেটাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy