Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

ভোটের ফলে ঢাকা পড়বে না অশান্তির খানাখন্দ

রক্তের দাগ নেই। বারুদের গন্ধ নেই। ওত পেতে বসে নেই অজানা আতঙ্ক। মাখনের মতো মসৃণ পিচরাস্তা দিয়ে সাঁ সাঁ ছুটছে গাড়ি। এখন কে বলবে, যত্রতত্র কেটেকুটে, আট-দশ পা অন্তর গাছ ফেলে এই রাস্তাকেই যানবাহন চলাচলের অযোগ্য করে তোলা হয়েছিল! শুধু গাড়িঘোড়া কেন, পাঁচ বছর আগে লালগড় থেকে রামগড় যাওয়ার এই পথে অদৃশ্য এক ‘প্রবেশ নিষেধ’ সাইনবোর্ড ঝোলানো ছিল পুলিশের জন্য।

সুরবেক বিশ্বাস
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০১৪ ০২:২১
Share: Save:

রক্তের দাগ নেই। বারুদের গন্ধ নেই। ওত পেতে বসে নেই অজানা আতঙ্ক। মাখনের মতো মসৃণ পিচরাস্তা দিয়ে সাঁ সাঁ ছুটছে গাড়ি।

এখন কে বলবে, যত্রতত্র কেটেকুটে, আট-দশ পা অন্তর গাছ ফেলে এই রাস্তাকেই যানবাহন চলাচলের অযোগ্য করে তোলা হয়েছিল! শুধু গাড়িঘোড়া কেন, পাঁচ বছর আগে লালগড় থেকে রামগড় যাওয়ার এই পথে অদৃশ্য এক ‘প্রবেশ নিষেধ’ সাইনবোর্ড ঝোলানো ছিল পুলিশের জন্য। এই পথের মাঝামাঝি অবস্থান ছোটপেলিয়া গ্রামের। যেখানে মাওবাদীদের খোঁজে মাঝরাতে হানা দেওয়া পুলিশের বন্দুকের কুঁদো থেঁতলে দিয়েছিল হতদরিদ্র আদিবাসী মহিলা ছিতামুনি মুর্মুর বাঁ চোখ। আর বন্দুকের নলকে যাঁরা ক্ষমতার উৎস বলে বিশ্বাস করেন, তাঁরা এই ধরনেরই পরপর ঘটে যাওয়া ঘটনায় জনসাধারণের ক্ষোভের আগুনে হাওয়া দিয়ে ধীরে ধীরে গোটা তল্লাটে চালু করেছিলেন প্রায় সমান্তরাল এক শাসনব্যবস্থা।

কিন্তু লালগড়-রামগড় রাস্তার সব কাটা দাগ বুজে যাওয়ার মতোই জঙ্গলমহল থেকে যেন উবে গিয়েছে মাওবাদীরা।

গোহমিডাঙার ব্যবসায়ী সঞ্জিত সামন্ত বলেন, “সন্ধে সাতটা বাজলে ঠাকুরকে প্রণাম করে বলতাম, রাতটা যেন ভালয় ভালয় কেটে যায়। এখন সেই ভয় নেই।” হাড়দা গ্রাম পঞ্চায়েতের আউলিয়া গ্রামের তপন কারকের কথায়, “সন্ধের পর প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার প্রয়োজন হলেও ঘর থেকে বেরোতাম না। এখন সব স্বাভাবিক।” রাধানগর গ্রামের গোপাল মান্নার বক্তব্য, “আমরা আগে রাতপাহারা দিতাম। আড়াই বছর যাবৎ তার প্রয়োজন হচ্ছে না।”

মাওবাদীদের হাতে গড়া, অধুনালুপ্ত পুলিশি সন্ত্রাসবিরোধী জনসাধারণের কমিটির সদর দফতর ছিল লালগড়ের বড়পেলিয়া চকে। এখন সেখানে গোটা দশেক দোকান। মাটির যে ঘরটায় টেলিভিশন সেটে প্রায়শই দক্ষিণ ভারতীয় ছবি চলত তেলুগু দীপকের মতো মাওবাদী নেতার মনোরঞ্জনে, তারই দেওয়ালে ‘জঙ্গলমহলের শান্তি ও উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে’ তৃণমূল প্রার্থী উমা সরেনকে ভোট দেওয়ার আবেদন।

তবে মাওবাদী হিংসা বন্ধ হওয়া আর শান্তি বজায় থাকা দু’টো বোধহয় এক নয়। স্থানীয়দের অনেকের অভিযোগ, মাওবাদী সন্ত্রাস কিংবা পূর্বতন শাসক দলের মদতে ঘটে যাওয়া নেতাই-হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনার শূন্যস্থান ভরাট করার দিকেই এগোচ্ছে বর্তমান শাসকের পুলিশের নিঃশব্দ জুলুম।

যার অন্যতম শিকার মাওবাদীদের পিপল্স লিবারেশন গেরিলা আর্মির প্রাক্তন নেতা, লোধাশুলির গজাশিমুল গ্রামের জয়দেব মাহাতো। অভিযোগ, পুলিশের শর্ত মোতাবেক জয়দেব শাসক দলে যোগ দিতে রাজি না হওয়ায় তাঁকে ফাটকে পোরা হয়।

জয়দেব একা নন, কাঁটাপাহাড়ির সঞ্জয় প্রতিহার, সিজুয়ার কিঙ্কর সিংহ, মেটিয়াশোলের বৈদ্যনাথ হাঁসদার বিরুদ্ধে পাঁচ বছরের পুরনো মামলার গ্রেফতারি পরোয়ানা ভোটের মুখে জারি করা হয়েছে। প্রাক্তন এই মাওবাদী কিংবা কমিটির সদস্যেরা কেউই শাসক দলে যোগ দেননি। এ প্রসঙ্গে পুলিশের যুক্তি, কারও বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকলে ভোটের মুখে তাকে তো ধরতেই হবে।

অথচ এই যুক্তিই খাটছে না অসংখ্য মাওবাদী কার্যকলাপে অভিযুক্ত, লালগড়ের দ্বারিগেড়িয়া গ্রামের সন্তোষ পাত্রের বেলায়। গত বছর পঞ্চায়েত ভোটে তৃণমূলের হয়ে সন্তোষ যে পুরোদস্তুর মাঠে নেমেছিলেন, সে কথা স্বীকার করছেন দলের স্থানীয় নেতৃত্বও। এক পুলিশকর্তার বক্তব্য, “মাওবাদী নেতা বিকাশ সদলবল লালগড়ে ঢোকার চেষ্টা করছে। ওদের ঠেকিয়ে রেখেছে সন্তোষ পাত্র ও তার সঙ্গীরা। তাই সন্তোষকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না।” পুলিশের কথাতেই পরিষ্কার, অশান্তি ফের দরজায় কড়া নাড়ছে।

অশান্তির আর এক কারণ, উন্নয়নমূলক কার্যকলাপে দুর্নীতির বিস্তর অভিযোগ। পরিবর্তনের জমানায় বাঁশবেড়ের মতো প্রত্যন্ত গ্রামেও বিদ্যুৎ পৌঁছেছে, মোরাম রাস্তা হয়েছে, পানীয় জলের অভাবও মিটেছে অনেকটাই। কিন্তু বহু মানুষই একবাক্যে বলছেন যে, উন্নয়ন যত, তার চেয়ে চুরি অনেক বেশি। ইন্দিরা আবাস প্রকল্পে ঘর পেতে নাকি শাসক দলের নেতাদের একাংশকে ‘কমিশন’ দিতে হচ্ছে। দলের অন্দরেই প্রশ্ন উঠেছে শাসক দলের বহু নেতার একাধিক আত্মীয়ের প্রাথমিক স্কুলশিক্ষকের চাকরি পাওয়া নিয়ে।

প্রসঙ্গ তুলতেই পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়নমন্ত্রী সুকুমার হাঁসদার তড়িঘড়ি সামাল দেওয়ার প্রয়াস, “একশো শতাংশ মানুষ কি সৎ হতে পারে? তবে আমরা এই সব অনিয়মে নিয়ন্ত্রণ আনার চেষ্টা করছি।”

মন্ত্রী যা-ই বলুন, তাঁদের প্রার্থীকে নিয়ে দলের একাংশের ক্ষোভ কিন্তু বহু চেষ্টা করেও চাপা দেওয়া যাচ্ছে না। এই বিক্ষুব্ধদের সাফ কথা কে এই উমা সরেন, যিনি ভাল ব্যবহারটুকুও করতে জানেন না!

শুভেন্দু অধিকারী, সুকুমার হাঁসদা-রা বেলাটিকরির অবসরপ্রাপ্ত হাইস্কুলশিক্ষক ও বহু দিনের তৃণমূল কর্মী দাখিন মুর্মুর নাম সুপারিশ করলেও তৃণমূল নেত্রী শেষ পর্যন্ত প্রার্থী হিসেবে বেছে নেন বছর দুয়েক আগে ডাক্তার হওয়া, ঝাড়গ্রামের উত্তর বামদার এই তরুণীকে। কলকাতা থেকে আসা সাংবাদিক তাঁকে নিজের পরিচয় দিয়ে কথা বলতে চাইলে এমবিবিএস উমা সটান মুখ ঘুরিয়ে নিজের এক সঙ্গীকে ফরমায়েশ করেন, “বলে দাও, আমি কথা বলতে পারব না।” তাঁর এহেন সৌজন্যের অভাবে যারপরনাই রুষ্ট তৃণমূলের স্থানীয় নেতৃত্বের একাংশ। সম্ভবত সেই কারণেই উমা যখন ঠা ঠা রোদে গোপীবল্লভপুর-২ ব্লকের চোরচিতা ও নোটা গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় মিনিডরে চড়ে প্রচার চালান, দলের ব্লক সভাপতি স্বপন পাত্র তখন দশ মাইলের মধ্যেও নেই।

প্রতিদ্বন্দ্বীর এমন দুরবস্থা। তবু সে সুযোগ সিপিএম নিতে পারলে তো!

প্রথমত, এ বার রাজ্যের বেশ কয়েকটি লোকসভা আসনে তৃণমূলের ভোট বিজেপি ও কংগ্রেস কেটে তাদের সুবিধে করে দেবে বলে মার্ক্সবাদীরা আশা করলেও ঝাড়গ্রামে যে সেটা হবে না, তা তাঁদের বিলক্ষণ জানা। প্রার্থী পুলিনবিহারী বাস্কে রাখঢাক না করেই বলে দেন, “লড়াইটা আমাদের সঙ্গে তৃণমূলের। এখানে বিজেপি, কংগ্রেস একেবারেই প্রাসঙ্গিক নয়।”

তার চেয়েও বড় সমস্যা হল, সিপিএম এখানে এতই দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত যে, সারানোর ওষুধ চিকিৎসক পুলিনবাবুরও জানা নেই। দলীয় সূত্রে খবর, লোকাল কমিটির প্রায় দু’শো সদস্য পার্টির সদস্যপদ নবীকরণই করাননি। অন্তত পাঁচটি লোকাল কমিটির সম্পাদক রাজনৈতিক কার্যকলাপ থেকে শত হাত দূরে। গোটা দশেক লোকাল কমিটি অফিসে তালা ঝুলছে। দশটি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকা, একশোরও বেশি গ্রামে ঢুকতেই পারছে না সিপিএম। পুলিনবাবু বলেন, “মাওবাদীদের হাতে পার্টির বহু নেতা-কর্মী খুন হয়েছেন। তাঁদের শূন্যস্থান পূরণ করতে তো সময় লাগবেই।” তার উপর নেতাই-কাণ্ডে তিন বছর ধরে ফেরার সিপিএমের লালগড় জোনাল কমিটির সম্পাদক অনুজ পাণ্ডের স্থলাভিষিক্ত হওয়া সুশান্ত কুণ্ডু পার্টির এই কঠিন সময়ে আমেরিকার বস্টনে ছেলের কাছে গিয়ে রয়েছেন।

উল্টো দিকে, প্রত্যন্ত গ্রামে কুঁড়েঘরের দেওয়ালেও জ্বলজ্বল করছে ঘাসফুল। যে সব দেওয়ালে পাঁচ বছর আগেও চকচক করত কাস্তে-হাতুড়ি-তারা। উমাকে নিয়ে অসন্তুষ্ট স্থানীয় তৃণমূল নেতারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদেই তাঁরা নিজের নিজের এলাকায় যে যাঁর মতো প্রাণপণ প্রচার করবেন।

এই নির্বাচনের ফলের মধ্যে হয়তো তাই জঙ্গলমহলের একদা সব চেয়ে উপদ্রুত এই তল্লাটের স্পন্দন তেমন ধরা পড়বে না। কিন্তু ভবিষ্যৎ অশান্তির বীজ রোপণ আটকানো যাবে কি না, সেটা প্রশ্ন!

প্রতীকী শোনায় জেলা পরিষদের খাদ্য কর্মাধ্যক্ষ, তৃণমূল নেতা, বড়পেলিয়ার ক্ষমানন্দ মাহাতোর কথা, “উপর উপর মনে হচ্ছে ভাল। একটা বর্ষা যেতে দিন, লালগড়-রামগড় রাস্তার ছাল-চামড়া উঠে খানাখন্দ সব বেরিয়ে পড়বে!”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

election in jhargram surbek biswas
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE