Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

মাতৃদুগ্ধের গুণ বোঝাতে হিমশিম

মাতৃদুগ্ধের কোনও বিকল্প নেই। দেশ জুড়ে এই প্রচার চলছে অনেক দিন ধরেই। কিন্তু শোনে কে? হাজারও কুসংস্কার আর রঙিন বিজ্ঞাপনের চটকে প্রত্যন্ত এলাকার মায়েরা দোটানায়। প্রশিক্ষণ দিতে গিয়ে এমনই অভিজ্ঞতা ঘাটাল মহকুমা হাসপাতালের নার্সদের। শহরাঞ্চলে চিকিৎসকদের প্রচেষ্টায় অনেকাংশেই বাড়ানো গিয়েছে মাতৃদুগ্ধ পানের প্রবণতা।

ঘাটাল মহকুমা হাসপাতালে প্রশিক্ষণ শিবির। — নিজস্ব চিত্র।

ঘাটাল মহকুমা হাসপাতালে প্রশিক্ষণ শিবির। — নিজস্ব চিত্র।

অভিজিৎ চক্রবর্তী
ঘাটাল শেষ আপডেট: ২৭ জুন ২০১৫ ০০:৩৫
Share: Save:

মাতৃদুগ্ধের কোনও বিকল্প নেই। দেশ জুড়ে এই প্রচার চলছে অনেক দিন ধরেই। কিন্তু শোনে কে? হাজারও কুসংস্কার আর রঙিন বিজ্ঞাপনের চটকে প্রত্যন্ত এলাকার মায়েরা দোটানায়। প্রশিক্ষণ দিতে গিয়ে এমনই অভিজ্ঞতা ঘাটাল মহকুমা হাসপাতালের নার্সদের।
শহরাঞ্চলে চিকিৎসকদের প্রচেষ্টায় অনেকাংশেই বাড়ানো গিয়েছে মাতৃদুগ্ধ পানের প্রবণতা। সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতালে শিশু জন্মের পরই নতুন মাকে বুঝিয়ে দেওয়া হয় ছ’মাস পর্যন্ত মাতৃদুগ্ধ ছাড়া অন্য আর কিছুই যেন না খাওয়ানো হয়, বিশেষত চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া।
কিন্তু সর্বত্র সেই সচেতনতা নেই। নতুন মায়েদের সচেতন করতেই প্রশিক্ষণের বিষয়ে উদ্যোগী হয়েছে গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশন। শিশু মৃত্যুর হার কমাতে ও রোগ প্রতিরোধে নবজাতক ও শিশুদের কী ভাবে খাওয়ানো হবে, তা নিয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। চলতি বছরের গোড়াতেই ইনফ্যান্ট অ্যান্ড ইয়ং চাইল্ড ফিডিং (আইওয়াইসিএফ) নামে নতুন এই প্রকল্পটি গোটা দেশ জুড়ে শুরু হয়েছে। সম্প্রতি এ রাজ্যেও কম বেশি বিভিন্ন স্তরের হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে একটি ইউনিট শুরু হয়েছে। গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশনের নির্দেশ থাকলেও পরিকাঠামোর অভাবে এতদিন পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় শুরু হয়নি সেই প্রশিক্ষণ। চলতি মাস থেকে মেডিক্যাল কলেজ, মহকুমা হাসপাতাল ও ২৯টি গ্রামীণ ও ব্লক হাসপাতালে চালু হয়েছে ইউনিটটি। ভাল সাড়াও মিলেছে বলে দাবি স্বাস্থ্য আধিকারিদের।

জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক গিরীশচন্দ্র বেরা বলেন, “পরিকাঠামোর অভাবে এতদিন আমরা এই বিভাগটি শুরু করতে পারিনি। বড় হাসপাতালগুলোতে শুরু হয়ে গিয়েছে এ মাসেই। এ বার জেলা জুড়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র গুলিতেও চালু হবে।”

আইওয়াইসিএফ ইউনিট গড়তে প্রতিটি হাসপাতালের জন্য প্রাথমিক ভাবে ৩০ হাজার টাকা করে বরাদ্দ হয়েছে। একটি বিশেষ ঘরকে গড়ে তোলা হয়েছে সুন্দর করে। সেখানেই রয়েছে একটি টিভি সেট। প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত নার্সরা সেই ঘরেই নতুন মায়েদের শেখাচ্ছেন শিশুকে খাওয়ানোর পদ্ধতি। প্রয়োজনে সাহায্যে নেওয়া হচ্ছে দৃশ্য-শ্রাব্য মাধ্যমের। রয়েছে নানা রকম পোস্টারও। ঘাটাল মহকুমা হাসাপাতালের নার্স চম্পা ভৌমিক বলেন, ‘‘ছ’মাস বয়স পর্যন্ত কোনও শিশুরই বাইরের খাবারের প্রয়োজন নেই। বরং শুধু মায়ের দুধ খেলেই শিশুর স্বাস্থ্য ভাল থাকে। সেই দুধ কখন, কী ভাবে, কতটা পরিমাণে খাওয়ানো হবে তারই প্রশিক্ষণ।’’

প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন হাসপাতালের নার্সদেরও। মূলত মেদিনীপুর শহরে মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের দফতরে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে নার্স এবং আশাকর্মীদের। ঘাটাল মহকুমা হাসাপাতালের আরেক নার্স বেরা খাঁড়া বলেন, ‘‘সত্যিই আমরাও জানতাম না কী ভাবে বোঝাবো মায়েদের। কাউন্সেলিং করার পদ্ধতি সম্পর্কে আমাদের শেখানো হয়েছে। এমনিতেই মায়েদের মধ্যে কোনও সচেতনতা নেই। ফলে তাঁদের বোঝানোটা খুব জরুরি।’’

কেমন চলছে প্রশিক্ষণ? রেবাদেবী জানান, প্রতিক্রিয়া মিশ্রও বলা যাবে না। বরং নেতিবাচক মনোভাবই বেশি। মায়ের বুকের দুধে একটি শিশুর প্রতিদিন ১৮-৩০ গ্রাম ওজন বাড়ে। অথচ গ্রামের মহিলারা বলেন, বিজ্ঞাপনে দেখানো কৌটোর দুধ না খাওয়ালে বাচ্চা বাড়বে কেমন করে? শিশুর জন্মের পর প্রথম যে হলুদ দুধ বা কোলেস্ট্রাম, তা রোগ প্রতিরোধক। গ্রামের মানুষের মনে সংস্কার বদ্ধমূল ওই দুধ খেলে নাকি জন্ডিস হয়।

চম্পা ভৌমিকের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী জুন মাসে এখনও পর্যন্ত প্রায় ৩৪০ জন মায়েক কাউন্সেলিং করা হয়েছে। তার মধ্যে ৫০ শাতংশ মা-ই বলেছেন আপনারা যাই বলুন, শাশুড়ি এ সব কথা শুনবে না। কৌটোর দুধ খাওয়াতেই হবে। সেই সঙ্গে, ডাল, কলা—আরও কত কী! মাত্র ১০ শতাংশ মা, হাসি মুখে বলেছেন হ্যাঁ, শুধু বুকের দুধই খাওয়াব। বাকি ৪০ শতাংশ কোনও প্রতিক্রিয়া জানাননি।

ঘাটালের ইরপালা গ্রাম থেকে এসেছিলেন মৌপিয়া মাজি, তাঁর দু’মাসের শিশুপুত্র। তিনি অবশ্য অনেকটা বুঝেছেন। মৌপিয়া বলেন, ‘‘সত্যিই ভাবতাম বাজার থেকে কেনা কৌটোর দুধই বেশি উপকারি। আমাদের তেমন সামর্থ্য নেই, তবু চেষ্টা করি দামী দুধ কিনতে। কিন্তু দিদিরা বোঝালেন, আমার বুকের দুই যথেষ্ট। কখন, কতটা খাওয়াতে হবে তাও শিখলাম।’’ শুধু হাসপাতালে ভর্তি মায়েদের নয়, বহির্বিভাগে চিকিৎসা করাতে আসা মায়েদেরও নিয়ে আসা হচ্ছে এই প্রশিক্ষণে। যে সব শিশুর জন্ম বাড়িতে বা বেসরকারি হাসপাতালে, তাদের প্রশিক্ষণ দেবেন আশাকর্মীরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE