Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

সমুদ্রের ঢেউ ভাঙে না সবংয়ের পাড়ে

সমুদ্রের ঢেউয়ের গর্জন আর শোনা যায় না। সুঙ্গ বংশের রাজাদেরও আজ কোনও অস্তিত্ব নেই। জনশ্রুতি, এক সময় বঙ্গোপসাগরের ঢেউ এসে ভাঙত সবংয়ের পাড়ে। এখন অবশ্য সবং থেকে সমুদ্রের দর্শন মেলে না। তবে সে দিনের সেই ছোট্ট জনপদ সবং ক্রমে আড়ে বহরে বেড়েছে।

সবং-এর তেমাথানিতে বেহাল নিকাশি। ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।

সবং-এর তেমাথানিতে বেহাল নিকাশি। ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।

দেবমাল্য বাগচী
সবং শেষ আপডেট: ৩০ অগস্ট ২০১৫ ০০:৩৫
Share: Save:

সমুদ্রের ঢেউয়ের গর্জন আর শোনা যায় না। সুঙ্গ বংশের রাজাদেরও আজ কোনও অস্তিত্ব নেই। জনশ্রুতি, এক সময় বঙ্গোপসাগরের ঢেউ এসে ভাঙত সবংয়ের পাড়ে। এখন অবশ্য সবং থেকে সমুদ্রের দর্শন মেলে না। তবে সে দিনের সেই ছোট্ট জনপদ সবং ক্রমে আড়ে বহরে বেড়েছে। সবংয়ের গায়ে লেগেছে শহুরে নাগরিক জীবনের ছোঁয়া। তবে স্থানীয় বাসিন্দাদের আক্ষেপ, জনবসতি বাড়লেও নাগরিক পরিষেবার উন্নতি হয়নি। পানীয় জল সরবরাহ ও সুষ্ঠু নিকাশির অভাবে জেরবার একদা ‘বন্যার শহর’ বলে পরিচিত সবংয়ের বাসিন্দারা।

সবংয়ের ইতিহাসের সন্ধানে পিছিয়ে যেতে হবে ২ হাজার ৭০০ বছর। স্থানীয় আলোর মেলা পত্রিকা প্রকাশিত ‘সবঙ্গ দর্পন’ গ্রন্থে সবংয়ের ইতিহাসের হদিস পাওয়া য়ায়। জনশ্রুতি, অশোকের কলিঙ্গ বিজয়ের সময়ে বঙ্গোপসাগরের ঢেউ আছড়ে পড়ত সবংয়ে। সমুদ্রের ঢেউ ভাঙায় এই এলাকার নাম হয় ‘সভঙ্গ’। দিনে দিনে সভঙ্গ থেকে সবঙ্গ হয়ে আজকের সবং। নাম বদলেছে ক্রমান্বয়ে। গঙ্গাসাগরে আশ্রম প্রতিষ্ঠার আগে কপিল মুনি সবঙ্গের কপাললোচন খেয়াঘাটে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার প্রমাণস্বরূপ কপালেশ্বরী নদীর তীরে এখনও কপাললোচন শিবালয় রয়েছে। স্থানীয়দের একাংশের মত, এখনও ওই এলাকায় গভীর নলকূপ খনন করলে লবণ মিশ্রিত জল পাওয়া যায় বলে। এর থেকেই প্রমাণইত হয় সমুদ্র সবংয়ের কাছেই ছিল। ।

তাম্রলিপ্ত বন্দর এলাকায় ৪০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ সুঙ্গ বংশের রাজত্ব ছিল। সেই থেকে সুঙ্গ বংশের নামানুসারে এই এলাকার নামকরণ হয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন। জনশ্রুতি, মেদিনীপুর জেলা একসময়ে কলিঙ্গ রাজ্যের (ওড়িশা) অন্তর্ভুক্ত ছিল। পরে এই জেলা বঙ্গের সঙ্গে মিশে যাওয়ায় এই অঞ্চলের নাম সবঙ্গ হয়েছে। ভাষাচার্য সুকুমার সেন জানিয়েছেন, এই অঞ্চলটি শত পরগনার শেষ পরগনা ছিল। সেই পরগনা পরে বঙ্গের সঙ্গে মিশে গিয়েছে। তাই শ’বঙ্গ থেকে অপভ্রংশ হয়ে সবং হয়েছে। আবার এমন মতও রয়েছে, এই অঞ্চলে বিভিন্ন সম্পদের প্রাচুর্য ছিল। স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশের মতে, অতীতে এই অঞ্চলে সম্পদের সমস্ত ‘অঙ্গ’ পরিপূর্ণ থাকায় ‘সব অঙ্গ’ থেকে সবঙ্গ হয়েছে। পরে সবঙ্গ থেকে সবং নামের উৎপত্তি হয়েছে।

এক সময়ে কপালেশ্বরী ঘেঁষা সবং মৌজা ঘিরেই বসতি বাড়তে থাকে। তবে বন্যার কারণে সবংয়ের পূর্বাংশ থেকে ক্রমে বসতি অপেক্ষাকৃত উঁচু পশ্চিমের দিকে সরে যেতে থাকে। বন্যাপ্রবণ হওয়ায় পূর্ব মেদিনীপুরের ময়না ব্লক থেকেও বহু লোক সবংয়ে এসে আশ্রয় নেয়। ক্রমে বসতি বাড়তে থাকায় গড়ে ওঠে দোকান-বাজার। স্থানীয় বাসিন্দা জয়ন্তপ্রকাশ ভৌমিক বলেন, “বছর পঞ্চাশেক আগেও এখানে অনেক ফাঁকা এলাকা ছিল। তখন সবংয়ে দু’চারটি পাকা বাড়ি ছাড়া সবই ছিল মাটির বাড়ি। বসতি বাড়ার সঙ্গে অধিকাংশ বাড়ি পাকা হয়েছে। তবে নিকাশি, পথঘাট, পথবাতি নিয়ে সমস্যা রয়েই গিয়েছে।”

ডেবরা-সবং রাস্তা এই অঞ্চলেই তিনভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে। একদিকের রাস্তা দেহাটি হয়ে পটাশপুর, অন্য রাস্তা নারায়ণগড়ে চলে গিয়েছে। মূল রাস্তা চলে গিয়েছে সবংয়ে। সবং থেকে ৭ কিলোমিটার উত্তরে দেভোগ গ্রাম পঞ্চায়েতের লুটুনিয়া মৌজার এই তেমাথানি এলাকাই সবংয়ের প্রবেশদ্বার। বছর দশকে আগে এখানে প্রতি ডেসিমেল জমির বাজার দর ছিল ৩৫ হাজার টাকা। এখন সেই দর বেড়ে দাঁড়িয়েছে দেড় লক্ষ টাকায়। স্থানীয় বাসিন্দা স্কুল শিক্ষক অরিজিৎ দাস অধিকারী বলেন, “জমির দাম হু হু করে বেড়েছে। এলাকায় বাড়ির সংখ্যা বাড়লেও নিকাশির বেহাল চিত্রটা আরও বেআব্রু হয়েছে।’’ একইভাবে, স্থানীয় বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক রাধানাথ শিট বলেন, “বছর কুড়ি আগেও এই এলাকার দেহাটি ও সবং যাওয়ার রাস্তা ছাড়া সব রাস্তাই কাঁচা ছিল। এখন যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে। তবে এলাকায় পানীয় জলের সঙ্কট রয়েছে। সব রাস্তায় পথবাতি না থাকায় সমস্যা হয়।’’

সবংয়ের বেহাল নাগরিক পরিষেবা নিয়ে কী বলছেন জনপ্রতিনিধিরা?

স্থানীয় তৃণমূল নেতা তথা জেলা কর্মাধ্যক্ষ অমূল্য মাইতি বলেন, “ব্লকের শহর এলাকা বলে পরিচিত সবং ও তেমাথানি জেলা পরিষদের এলাকা নয়। ওই অঞ্চলে সমস্যা সমাধানে পঞ্চায়েত সমিতি ও বিধায়কের উদ্যোগী হওয়া উচিত।’’ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি তথা ব্লক কংগ্রেস সভাপতি অমল পণ্ডা বলেন, “শহরের সম্প্রসারণ হলেও নিকাশির মতো শহরে কিছু সমস্যা রয়েছে, এটা স্বীকার করছি। তবে আমাদের পঞ্চায়েত সমিতিকে তৃণমূল পরিচালিত জেলা পরিষদ গুরুত্ব দিচ্ছে না। ফলে অর্থের অভাবে কাজ আটকে থাকছে। তবে শহরের উন্নয়নে লড়াই চালিয়ে যাব।’’

স্থানীয় কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়া বলেন, “সবংয়ে পানীয় জল প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের ২২টি ইউনিট করেছি। পানীয় জলের প্রকল্পের দ্বিতীয় ইউনিট করা উচিত। বন্যা প্রতিরোধে নদী সংস্কারও করা হয়েছে।’’ তাঁর বক্তব্য, ‘‘ সবংয়ে হাসপাতালের মানোন্নয়ন প্রয়োজন। সবংয়ে প্রেক্ষাগৃহ, হোটেল, গেস্টহাউস, মহিলা কলেজ নেই। নিকাশিরও সমস্যা রয়েছে। এই সবের জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি। সরকার টাকা দিলেই এই কাজগুলি করা হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE