Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

ভাষার ভিত মজবুত করার পাঠ সাহিত্যিকের

দীর্ঘ পঞ্চান্ন বছর ধরে তিনি সাহিত্যচর্চা করছেন। ইতিমধ্যে তাঁর লেখা ১৩টি সাহিত্য সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। সেই সঙ্গে ৭৮ বছর বয়সেও ছাত্রীদের জন্য অবৈতনিক ‘সৃজনশীল ভাষা শিক্ষা’র নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন নন্দদুলাল রায়চৌধুরী।

ক্লাস নিচ্ছেন নন্দদুলাল রায়চৌধুরী। —নিজস্ব চিত্র।

ক্লাস নিচ্ছেন নন্দদুলাল রায়চৌধুরী। —নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
খড়্গপুর শেষ আপডেট: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০২:১০
Share: Save:

দীর্ঘ পঞ্চান্ন বছর ধরে তিনি সাহিত্যচর্চা করছেন। ইতিমধ্যে তাঁর লেখা ১৩টি সাহিত্য সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। সেই সঙ্গে ৭৮ বছর বয়সেও ছাত্রীদের জন্য অবৈতনিক ‘সৃজনশীল ভাষা শিক্ষা’র নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন নন্দদুলাল রায়চৌধুরী। রবিবার খড়্গপুরের সুভাষপল্লি জনকল্যাণ সমিতিতে এই পাঠক্রমের একাদশ পর্বের প্রথম পাঠদান শুরু হল। উচ্চশিক্ষায় ছাত্রীদের এগিয়ে দিতে ২০১১ সাল থেকে এই উদ্যোগের শুরু। প্রতি বার ১০ জন করে ছাত্রীকে এই ভাষা শিক্ষা দেওয়া হয়। কিন্তু এ বার এতটাই চাহিদা ছিল যে ২১ জন ছাত্রীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। শুধু ভাষাশিক্ষা নয়, সাংবাদিকতা, গৃহসজ্জা, পরিবেশ বিজ্ঞান, প্রবন্ধ ও গল্প লেখার কৌশলও হাতে-কলমে শেখানো হচ্ছে। ষাণ্মাসিক এই প্রশিক্ষণকে স্বীকৃতি দিয়েছে রেল প্রশাসন।

রেলশহরে সাহিত্যিক হিসেবে নন্দদুলাল রায়চৌধুরীর পরিচিত দীর্ঘদিনের। এক সময়ে রেলের সিনিয়র সেকশন অফিসারের পদে কর্মরত ছিলেন তিনি। সমান্তরাল ভাবে চালিয়ে গিয়েছেন সাহিত্যচর্চাও। তাঁর লেখা চিঠির সংকলন ‘তথ্যপ্রভা’ (দুই খণ্ড), প্রবন্ধ সংকলন ‘নিমকথা’, চিকিৎসা সংকলন ‘পল্লবগ্রাহী ডায়েরি’ (দুই খণ্ড)-সহ তাঁর লেখা ১৩টি বই প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়াও বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তিনি প্রতিনিয়ত লিখে চলেছেন। সদ্য সমাপ্ত খড়্গপুর বইমেলায় বাংলাদেশের উপ-হাই কমিশনার জকি আহাদের হাতে তাঁর লেখা ‘খড়্গপুর রেল কারখানার অতীত ও বর্তমান’ প্রকাশিত হয়েছে। নিজে সাহিত্যচর্চা চালিয়ে গেলেও পড়ুয়াদের ভাষাজ্ঞান চিন্তিত ছিলেন নন্দদুলালবাবু। তারপরই এই উদ্যোগ। নন্দদুলালবাবুর কথায়, “২০১০ সালে রেল বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ শিবিরে গিয়েছিলাম। তার পরে ওই স্কুলের তদানীন্তন অধ্যক্ষ আমাকে ছাত্রীদের ‘কো-ক্যারিকুলার অ্যাক্টিভিটি’র জন্য কিছু করার উৎসাহ দেন। ২০১১ থেকে রেল স্কুলের ছাত্রীদের প্রথম-দশম পর্বে সৃজনশীল ভাষাশিক্ষা দান করেছি। এ বার শহরের বিভিন্ন স্কুলের ছাত্রীরা উৎসাহ দেখিয়েছে। আমি আপ্লুত।’’

ইতিমধ্যে এই পাঠ্যক্রমকে কো-ক্যারিকুলার অ্যাক্টিভিটি হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে রেল প্রশাসন। প্রতিটি পাঠ্যক্রমের শেষে ছাত্রীদের পুরস্কৃত করা হয় ও শংসাপত্র দেওয়া হয়। এত দিন পাঠক্রম ত্রৈমাসিক থাকলেও দশম পর্ব থেকে তা ষাণ্মসিক করা হয়েছে। পরিচালনায় এগিয়ে এসেছে খড়্গপুরের ঘরোয়া সাহিত্য বাসর। প্রতি রবিবার শহরের বিভিন্ন স্কুলের নবম ও দশম শ্রেণির ছাত্রীকে এই প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। রেল বালক উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ প্রীতিময় গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “এখন পড়ুয়াদের মধ্যে নোটবই নির্ভর পড়াশুনো দেখা যায়। নিজেদের লেখার ক্ষমতা কমছে। আমি বালিকা বিদ্যালয়ে থাকাকালীন নন্দদুলালবাবুর তাই কিছু একটা করার কথা বলেছিলাম। উনি যে ভাবে আগ্রহ দেখিয়ে বিনামূল্যে এই পাঠ্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তা প্রশংসনীয়। আমরাই কয়েকজন মিলে ওই শিক্ষার্থীদের শংসাপত্র দিচ্ছি।”

শুধু ভাষা শিক্ষায় জ্ঞানবৃদ্ধি নয়, এখন এই পাঠ্যক্রমের সঙ্গে গণিত, অভ্যন্তরীণ গৃহসজ্জা, সাংবাদিকতার মতো বিষয় যুক্ত করা হয়েছে। ঠিক হয়েছে, প্রবীণ এই সাহিত্যিকের সঙ্গে মাঝেমধ্যে ক্লাস নেবেন বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজের দন্ত চিকিৎসক ইন্দ্রনীল কুলাভি, গণিতের অধ্যাপক তপনকুমার পাল, আইআইটির অধ্যাপক পবিত্র শাণ্ডিল্য প্রমুখ।

নন্দদুলালবাবু বলেন, “ছাত্রীদের আরও উৎসাহ দিতে সাংবাদিকতার পাঠ শিখিয়ে বিভিন্ন স্থানীয় পত্রিকায় পাঠিয়ে দিচ্ছি। সেগুলি প্রকাশিত হচ্ছে। সকলের সাহায্য পাচ্ছি। কী ভাবে দাঁতের যত্ন নিতে হবে, বাড়ি কী ভাবে সাজাবে, সুস্থ পরিবেশ গঠনে ঘরোয়া টিপস দেওয়া হচ্ছে ছাত্রীদের। কারণ সুস্থ পরিবেশ ও মনে ভাষা উন্মুক্ত হয়।’’

গত ছ’বছরে দশম পর্ব পর্যন্ত এই সৃজনশীল ভাষা শিক্ষার পাঠক্রমে ৮৬ জন ছাত্রী প্রশিক্ষণ নিয়েছে। অতুলমণি বালিকা বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষিকা সবিতা পাত্র, শিক্ষিকা মনীষা সিংহ-সহ কয়েকজন শিক্ষিকাও প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। নোটবই মুখস্থ করে লেখার বদলে কী ভাবে পড়ুয়ারা নিজের ভাষায় উত্তর লিখবে সেই ধারণা দেওয়া হচ্ছে এই পাঠক্রমে। প্রতি মাসের শেষ রবিবার খড়্গপুর বালক বিদ্যালয়ের ঘরোয়া সাহিত্য বাসরে বহু স্কুল-কলেজ পড়ুয়া, শিক্ষক, শিক্ষানুরাগী, লেখক এই ভাষাশিক্ষা নিয়ে চর্চা করে চলেছেন।

একাদশ পর্বের প্রথম দিনের ক্লাসে ১৭জন উপস্থিত ছিল। তাঁদের মধ্যেই উপস্থিত দশম শ্রেণির সায়ন্তিকা দাশগুপ্ত, জয়িতা মণ্ডল, নবম শ্রেণির জয়শ্রী ঘোষ, দিয়া দত্তদের কথায়, “সামনেই মাধ্যমিক পরীক্ষা। অনেক জায়গায় টিউশন নিই। শিক্ষকেরা নোটস দেন। সেগুলোই পড়তাম। এ বার যদি নিজেরা লিখতে পারি তাহলেই স্যার যে ভাবে শেখালেন সেই উদ্দেশ্য সফল হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE