বিশ্বনাথ মুদি, বন সুরক্ষা কমিটির সদস্য
শাবল দিয়ে হাতি খেদানোর গাড়ির দরজাটা তখন ভাঙা হচ্ছে। মনে মনে প্রমাদ গুনছি। ভাবছি, ভেতরে কী না কী দেখব। দরজার একটা পাল্লা খুলতেই কয়েক হাত ছিটকে গেলাম— ভেতরে দু’-দু’টো লাশ। একটা গাড়ির সিটে পড়ে আছে, অন্যটা পড়ে রয়েছে মেঝেতে। মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগেও যে মানুষগুলোর সঙ্গে গল্পগুজব করেছি, রুটি-তরকা খেয়েছি— গাড়ির ভেতরে তাদের দেহ।
সোমবার রাত এগারোটা নাগাদও একবার হাতি খেদানোর গাড়ির মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন অমল চক্রবর্তী আর দামোদর মুর্মু। তখন অবশ্য জেনারেটর চলছিল না। পরে ঘুম থেকে উঠে ওঁরা আমাদের সঙ্গে রুটি-তড়কা খান, গল্পগুজবও করেন। তখনও বুঝিনি সেই শেষ কথা।
গভীর রাতে কুয়াশায় জঙ্গলে কিছু দেখা যাচ্ছিল না। রাত তিনটে নাগাদ আমরা, বন সুরক্ষা কমিটির কয়েকজন সদস্য গিয়ে দামোদরদের বলি, ‘গাড়ির আলো জ্বেলে নিন’। ওঁরা আলো জ্বালান, জেনারেটরও চালু করেন। তারপর কখন যে গাড়ির সব দরজা-জানলা বন্ধ করে ঘুমোতে গিয়েছেন, খেয়াল করিনি।
আরও পড়ুন: বাঘ-ভয়ে বন্ধ গাড়ি, মৃত ২
কিছুটা দূরে মহারাজপুরের জঙ্গলে বাঘ ধরার খাঁচা পাতা হয়েছে। গাড়িটা ছিল প্রায় এক কিলোমিটার দূরে হামারগ্যেড়ার জঙ্গলরাস্তায়। আমরাও ২০-২২ জন হামারগেড়্যাতেই বাঘের অপেক্ষায় রাতভর জেগে ছিলাম। মঙ্গলবার ভোর পাঁচটা নাগাদ দেখি, হাতি খেদানোর গাড়িতে আলো জ্বলছে। কেমন একটা সন্দেহ হয়। তবে কি কোনও বিপদ হল!
এরপর আমরা, বন সুরক্ষা কমিটির সদস্যরা গিয়ে দামোদর আর অমলের নাম ধরে অনেক ডাকাডাকি করি। কিন্তু কোনও সাড়া নেই। গাড়িটার দরজা-জানলা সব বন্ধ। বাইরে থেকে অনেক চেষ্টা করেও কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। সেই সঙ্গে কী ভাবে দরজা খুলব শুরুতে ভেবে পাচ্ছিলাম না সেটাও। পরে বন দফতরের আধিকারিকদের জানাই, দরজা ভাঙা ছাড়া উপায় নেই। ওঁরা অনুমতি দিলে শাবল এনে শুরু হয় দরজা ভাঙা। তারপরই চোখের সামনে দেখি সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্য!
বনে-জঙ্গলে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে আমরা অভ্যস্ত। কতবার হাতির পালের মুখে পড়েছি। তাড়া খেয়েছি। কিন্তু এই তল্লাটে বাঘের দেখা তো মেলে না। তাই বাঘের জন্য রাতপাহারাও এই প্রথম। তাই ভয় আছে। দামোদর আর অমলও বোধহয় ভয়ের চোটেই গাড়ির সব দরজা-জানলা আটকে দিয়েছিলেন। বোঝেননি ডিজেলের ধোঁয়ায় জীবনটাই শেষ হয়ে যাবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy