অনুষ্ঠানের মুহূর্ত
হারিয়ে গিয়েছে খেলার মাঠ, তাই ক্রমশ এগিয়ে আসছে নীল তিমির বিশাল হাঁ।
সত্যিই কী তাই!
বয়স যাদের আঠারো পেরোয়নি, তারাই জানাল তাদের মতামত। কেউ বলল খেলতে যাওয়ার সময় নেই, কেউ জানাল মাঠে খেলার ইচ্ছেটাই মরে গিয়েছে। কারও আঙুল আবার সোজা উঠে গেল বাবা-মায়ের দিকে। তাঁদের সময় নেই বলেই তো একাকিত্বের অন্ধকারে ভেসে আসে নীল তিমিরা। তবে মাঠের মাঝে হঠাৎ উঠে পড়া অট্টালিকাও যে কম ‘ভিলেন’ নয়— তা জানাতেও ভুল করেনি ওরা।
শুক্রবার হলদিয়ায় একটি ক্লাবের উদ্যোগে আয়োজন করা হয়েছিল বিতর্ক প্রতিযোগিতার। যোগ দেয় শহরের দশটি স্কুলের ২০ জন পড়ুয়া— সকলেই অষ্টম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির। নতুন প্রজন্মের মুখে সঙ্কটের কথা শুনে অনেকটাই উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা। আবার অনেকেই মনে করছেন, এ থেকেই উঠে এল সমাধানের পথও।
বিতর্ক বিষয়ের পক্ষে মত রেখে পৌর পাঠভবনের ছাত্রী বনশ্রী দত্ত বল, ‘‘মাঠ নেই। তাই বাধ্য হয়েই আমাদের ঘরে বসে থাকতে হয়। হাতে উঠে আসে স্মার্ট ফোন। সেখান থেকেই তো যত সমস্যার শুরু।’’ তবে তার বক্তব্যের বিরোধিতা করে বাজিতপুর সারদামণি বালিকা বিদ্যালয়ের পায়েল দাস স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, ‘‘শুধু খেলার মাঠের অভাবের কথা বলে লাভ নেই। আমাদের বা আমাদের বাবা মায়ের মানসিকতা পরিবর্তনেরও প্রয়োজন।’’ পায়েলের দাবি, প্রতিদিন বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে টিউশন যেতে হয়। বাধ্য করেন বাবা-মা। শুধু মাঠ কেন। বারান্দা দিয়ে একটু আকাশ দেখারও যে ফুরসত নেই। বাড়ি ফিরে রাতের অন্ধকারে তাই মোবাইল নিয়ে বসতে হয়। স্যোশাল নেটওয়ার্কেই বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ।
পৌর পাঠভবনের শৌভিকা মাইতিও পায়েলের পাশে দাঁড়িয়েছে। সে জানিয়েছে দোষ শুধু মাঠ-চুরির নয়। চুরি গিয়েছে জীবনটাই। যৌথ পরিবার ভেঙে যাওয়ায় নতুন প্রজন্ম বড় একা। খুড়তুতো বোনের সঙ্গে দেখা হয় সোশ্যাল সাইটে। সেখানে মাঝে মধ্যে কথা, একটু ছবি দেখা। খুনসুটির সুযোগ নেই। নেই দাদু বা ঠাকুরদার ছায়াও। গল্প শোনানোর দিম্মাকেও অনেক দিন আগে ছেড়ে চলে এসেছি অন্য বাড়ি। ফলে স্মার্ট ফোনই ‘পরম আত্মীয়’।
লক্ষ্যা হাইস্কুলের শুভদীপ তুঙ্গ মনে করে দায় অনেক বেশি বাবা-মায়ের। ব্লু হোয়েল বা ওই রকম খেলা খেলতে অনেক সময় বাধ্য করে অ্যাডমিন’রা। শুভদীপের প্রশ্ন, ‘‘এ ভাবে কি কাউকে বাধ্য করা যায়?’’ বাবা-মাকে আরও সময় দিতে হবে। সন্তান মোবাইলে কী করছে, তা জানার দায়িত্বও তো তাঁদেরই।
বাবা মায়েরা সময় দিচ্ছেন না— এমন অভিযোগ তুলল অনেক পড়ুয়াই। হলদিয়া হাইস্কুলের সংযুক্তা জানার সাফ কথা, ‘‘স্মার্টফোন ছাড়া অচল আমরা। বিজ্ঞানের ভালো দিককে আমরা অস্বীকার করতে পারি না।’’ আবার, পরাণচক হাইস্কুলের পৌলমি মণ্ডল জানালো, ‘‘পড়াশোনার চাপ, বাবা মায়ের চাপ, প্রতিবেশীর সঙ্গে নম্বর নিয়ে তুল্য-মূল্য বিচারে হারিয়ে যাচ্ছে শৈশব। এই যন্ত্রণা লুকোব কোথায়?’’ তাই, যন্ত্রণা মুক্তির দিশা দেখায় স্মার্ট ফোনের নীল আলো। অথচ, তার নীচেই জমে থাকে অন্ধকার। খারাপ হচ্ছে মন, খারাপ হচ্ছে চোখও। মনোহরপুর হাইস্কুলের কবিতা মাইতির কথায়, ‘সচেতনতাই একমাত্র উপায় এই অন্ধকার থেকে বের করে আনার।’’
ছোটছোট ছেলেমেয়েদের বিতর্কে আপ্লুত উদ্যোক্তা সৌগত কাণ্ডার, কৌশিক মাজিরা। তাঁরা জানালেন, ‘‘ছাত্রছাত্রীরা এতো ভালো বলবে, আশা করিনি। স্মার্টফোন ছেলেমেয়েদের হাতে তুলে দিতেই হয়। অনলাইনে নানা ধরনের অ্যাকাডেমিক সাপোর্ট পায় তারা। সে দিক থেকে দেখতে গেলে, আমাদের ভাবিয়ে তুলল এই তরুণ প্রজন্ম।’’
একটি স্কুলের শিক্ষিকা মানসী দাস বললেন, ‘‘ছেলেমেয়েরা কিন্তু বাবা-মা আর সমাজের বিরুদ্ধেই অভিযোগ করে গেলো। ওরা আরও সময় চায়।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy