Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

লুপ্তপ্রায় পরভা নাচ বাঁচিয়ে রাখতে কর্মশালা

ঊনবিংশ শতকে চিল্কিগড়ে রাজা এবং প্রজাদের কাছে পরভা নাচই ছিল বিনোদনের প্রধান মাধ্যম। ‘মহিষাসুর বধ’, ‘সতীর দেহত্যাগ’, ‘সিপাহী বিদ্রোহ’-এর মতো পৌরাণিক ও সামাজিক কাহিনির নৃত্যশৈলির মাধ্যমে লোকশিক্ষাও হতো।

ঐতিহ্য: কর্মশালায় গণেশের পরভা হাতে শিক্ষার্থীরা। নিজস্ব চিত্র

ঐতিহ্য: কর্মশালায় গণেশের পরভা হাতে শিক্ষার্থীরা। নিজস্ব চিত্র

কিংশুক গুপ্ত
ঝাড়গ্রাম শেষ আপডেট: ২০ নভেম্বর ২০১৭ ০১:০১
Share: Save:

রাজপ্রাসাদের আঙিনায় মশাল জ্বালিয়ে বসেছে পরভা নাচের আসর। মুখ থেকে কোমর পর্যন্ত কাঠের অবয়ব (পরভা) পরে ঢোল-সানাই-ঢাকের তালে রাজার পাইকরা পরভা নাচ প্রদর্শন করছেন। সংলাপহীন অঙ্গভঙ্গি আর নাচের কৌশল দেখে আপ্লুত সপার্ষদ রাজা মানগোবিন্দ ধবলদেব রব তুলছেন ‘সাধু সাধু’! দেড়শো বছরেরও বেশি আগে রাজা মানগোবিন্দের পৃষ্ঠপোষকতায় গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় এমনই আসর বসত চিল্কিগড় রাজপ্রাসাদ চত্বরে।

ঊনবিংশ শতকে চিল্কিগড়ে রাজা এবং প্রজাদের কাছে পরভা নাচই ছিল বিনোদনের প্রধান মাধ্যম। ‘মহিষাসুর বধ’, ‘সতীর দেহত্যাগ’, ‘সিপাহী বিদ্রোহ’-এর মতো পৌরাণিক ও সামাজিক কাহিনির নৃত্যশৈলির মাধ্যমে লোকশিক্ষাও হতো। রাজতালুকের বাগদি পাড়ার সদস্যদের বেশির ভাগই ছিলেন রাজার পাইক বা লেঠেল। মূলত তাঁরাই নাচতেন। রাজপরিবারের কয়েকজন সদস্যও পরবর্তী কালে এই নাচের কৌশল রপ্ত করেন। কিন্তু চিল্কিগড়ের সেই ঐতিহ্যবাহী পরভা নাচের পরম্পরা এখন বিলুপ্তির অন্ধকারে হারিয়ে যেতে বসেছে।

তবে এ বার দেখা গিয়েছে আশার আলো— অবশেষে পরভা নাচের পুনরুজ্জীবনে উদ্যোগী হয়েছে রাজ্য সরকার। এ ব্যাপারে সাহায্য নেওয়া হচ্ছে ঝাড়গ্রামের বর্ষীয়ান লোক শিল্প ও সংস্কৃতি গবেষক সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের। পরভা নাচের পুনরুজ্জীবনে সরকারি হস্তক্ষেপ চেয়ে রাজ্য সরকারের কাছে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন সুব্রতবাবু। অবশেষে তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের অর্থসাহায্যে পরভা মুখোশ, পোশাক ও নৃত্য আঙ্গিক সংরক্ষণের কাজ শুরু হল। শনিবার ঝাড়গ্রাম জেলা তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের সভাঘরে আয়োজিত হয় এক দিনের ‘লুপ্তপ্রায় লোক আঙ্গিক ভিত্তিক লোকশিল্পীদের বিশেষ কর্মশালা’।

বর্তমানে পরভা নাচের মাত্র ২ জন শিল্পীই জীবিত রয়েছেন। তাঁদেরই এক জন ৭১ বছরের ভুবন খামরই উপস্থিত ছিলেন কর্মশালায়। তিনি পরভা নাচের নানা শৈলী দেখান। জানা গিয়েছে, সরকারি উদ্যোগে জামবনি ব্লকের দুবড়া গ্রামের একটি পাইক নৃত্য দলকে পরভা নাচের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। সেই দলের ২২ জন লোকশিল্পীকে মাসখানেক ধরে চিল্কিগড়ে প্রশিক্ষণ দেবেন ভুবনবাবু। এর পর ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে ঝাড়গ্রাম জেলা তথ্য ও সংস্কতি দফতরের সভাঘরে মহড়া প্রদর্শনী হবে। আগামী জানুয়ারিতে কলকাতায় পরভা নাচের প্রথম প্রদর্শনী করার ভাবনা রয়েছে রাজ্য সরকারের।

শনিবার কর্মশালায় রাজ্যের উপ-সংস্কৃতি অধিকর্তা বাসুদেব ঘোষ জানান, বেশ কয়েক বছর আগে সুব্রতবাবুর প্রচেষ্টায় এবং চিল্কিগড় রাজ পরিবারের সৌজন্যে ১২টি প্রাচীন পরভা মুখোশ তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের হেফাজতে আসে। মুখ থেকে কোমর পর্যন্ত কাঠের তৈরি শিব, অষ্টভুজা দুর্গা, গরুড়, ইন্দ্র, শিবদুর্গা, কৃষ্ণের পরভাগুলি বেশ ভারী। তখনকার দিনে বলশালীরা এগুলি পরে স্বচ্ছন্দে নাচতে পারতেন। এখন কাঠের পরভা তৈরি করার মতো সেই সব সূত্রধরেরা আর জীবিত নেই বলে জানান বাসুদেববাবু। সে কারণে কাগজের মণ্ড ও শোলা দিয়ে হাল্কা ওজনের পরভা মুখোশ তৈরি করা হবে। সেগুলি বানাবেন পুরুলিয়ার চড়িদা গ্রামের ছৌ মুখোশ শিল্পী কিশোর সূত্রধর। শনিবার কর্মশালায় এসে কাঠের পরভাগুলি দেখে দিয়েছেন কিশোরবাবু। তাঁর কথায়, “পুরনো ঐতিহ্যকে নতুন আঙ্গিকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে চেষ্টা করব সাধ্য মতো।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Parva Jhargram Dance
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE