ওরা-কাজ-করে: ঘাটালে স্টোনচিপস্ বস্তাবন্দি করার কাজে ব্যস্ত কিশোরেরা। ছবি: কৌশিক সাঁতরা
খাতায় কলমে নাম রয়েছে অনেকের। যদিও তাদের কেউ বা মাসে পাঁচ দিন কেউ কেউ আবার তার থেকেও কম দিন যায় স্কুলে। শিশু শ্রমিকদের পড়শোনা করানো ও স্বনির্ভর করে তোলার জন্য স্কুল চালু হয়েছিল। যদিও এরপরেও শিশু শ্রমে রাশ টানা যায়নি বলে অভিযোগ।
শিশু শ্রম বন্ধ করতেই শ্রম আইন চালু করেছিল কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রম দফতর। ১৯৮৬ সালে এই আইন চালু হয়। ১৯৮৭ সাল থেকে বিভিন্ন রাজ্যে চালু হয় শিশু শ্রমিক বিদ্যালয়। ১৪ বছর বয়সের নীচের শিশু শ্রমিকদের সমাজের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনাই ছিল এই স্কুলগুলির উদ্দেশ্য। পরবর্তীকালে চালু হওয়া শিক্ষার অধিকার আইনেও ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুর শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কোনও প্রতিষ্ঠানে শিশু শ্রমিককে দিয়ে কাজ করালে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মালিকের বিরুদ্ধে মামলা করার নিদানও রয়েছে। এ ক্ষেত্রে আইন অনুযায়ী জেল ও জরিমানা দুই-ই হওয়ার কথায়। যদিও এইসব আইন রয়েছে খাতায়-কলমেই। এরপরেও শিশুশ্রমিকের সংখ্যা কমেনি বলে অভিযোগ।
শিশু শ্রমিক বিদ্যালয়গুলিতে ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ানোর পাশাপাশি স্বনির্ভর করে তোলার সুযোগও রয়েছে। স্কুলেই জরির কাজ, দর্জির কাজ, পাতা তৈরি-সহ নানা ধরনের কাজের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রতি মাসে দেড়শো টাকা করে ভাতাও দেওয়া হয়। এরপরেও কেন স্কুলগুলিতে কমছে উপস্থিতির হার।
প্রশাসনিক আধিকারিকরা বলছেন, ‘‘দারিদ্রই এর প্রধান কারণ। গরিব পরিবারের ছেলেমেয়েরা বাড়িতে থেকে বাবা-মাকে নানা কাজে সাহায্য করছে। এ সব কাজের পরে সময় পেলে তবেই তারা স্কুলে আসছে।’’ চন্দ্রকোনার নিচনা গ্রামের বাসিন্দা পূজা পণ্ডিতের বাবা পিন্টু পণ্ডিত মাছের ব্যবসা করেন। মা হীরা পণ্ডিত দিনমজুরি করেন। বছর দশেকের পূজা আগে পরিচারিকার কাজ করত। বিষয়টি জানতে পরে পূজাকে শ্রম দফতরের কর্মীরা শিশু শ্রমিক বিদ্যালেয় ভর্তি করে দেন। এখনও পূজা স্কুল থেকে ফিরে সংসারে হাল ফেরাতে নানা কাজ করে। একইভাবে, চন্দ্রকোনার বেলাদণ্ডের বাসিন্দা সোমা হাঁসদাও অন্যের গরু-ছাগল চরায়। স্কুলে এলেও সংসারে সাহায্য করতে তাকে এখনও মাঝে মধ্যেই ওই কাজ করতে হয়।
এই চিত্র গোটা পশ্চিম মেদিনীপুর জুড়েই। স্কুলের খাতায় নাম থাকলেও কেউ মাসে দিন দশেক বা কেউ তারও কম দিন স্কুলে যায়। আর বাকি দিনগুলিতে কোনও না কোনও কাজ করেই বাবা-মাকে সাহায্য করে তারা।
প্রতিদিন যে সব ছাত্র-ছাত্রী স্কুলে আসছে না, তা স্বীকার করছেন চন্দ্রকোনার নিচনা শিশু শ্রমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা সুচিত্রা রায়। তিনি বলছেন, “কোনও ছাত্র না এলে তার বাড়ি গিয়ে স্কুলে আসতে বলি। তাতে কাজও হয়। কিন্তু দু’চারদিন পর ফের তাদের স্কুলে আসা অনিয়মিত হয়ে পড়ে।” শিশু শ্রমিক স্কুলগুলির পরিকঠামোও তচৈবচ। গোয়ালতোড়ের এক শিশু শ্রমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বলেই ফেললেন, “কোনও দিন স্কুলে পরিদর্শন হয়না। আমরা ভাতাও ঠিক মতো পাইনা। সরকার উদাসীন।”
জেলায় জেলায় জাতীয় শিশু শ্রমিক প্রকল্প আধিকারিক এই সব স্কুলগুলির দেখভাল করেন। দফতরের পশ্চিম মেদিনীপুরের প্রজেক্ট অফিসার তাপস মুখোপাধ্যায়ের দাবি, জেলায় এই স্কুলগুলি ঠিক মতোই চলছে। ৪২টি স্কুলে মোট ১৬৭২ জন ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে। এদের সকলেই শিশু শ্রমিক। তাপসবাবুর দাবি, স্কুলগুলিতে নিয়মিত পরিদর্শন হয়। স্কুল ছুটের হারও বন্ধ করার চেষ্টা চলছে। যদিও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলার শ্রম দফতরের এক আধিকারিক বলেন, “ঠিক মতো গণনা করলে জেলায় শিশু শ্রমিকের সংখ্যা পাঁচ হাজারেরও বেশি হবে।” তাই আদতে শিশু শ্রমে কবে রাশ টানা যায়, সেটাই দেখার!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy