দুর্ভোগ: খড়্গপুর শহরে অচল ট্রাফিক সিগন্যাল। নিজস্ব চিত্র
অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্ক ম্যানেজার তথা সাহিত্যিক তপন তরফদারের বয়স এখন ৭০ ছুঁইছুঁই। ছোট থেকে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা ছিলই। তার উপর ২০১২ সালে এক পথ দুর্ঘটনায় পা ভেঙে বিপদ আরও বাড়ে। তাতে অবশ্য খড়্গপুরের প্রেমবাজার সোসাইটির বাসিন্দা এই বৃদ্ধের মনোবল ভাঙেনি। লাঠিতে ভর করেই চলাফেরা করেন তপনবাবু। যান নানা সাহিত্যসভায়। কিন্তু রেলের শহর, আইআইটি-র শহর হওয়া সত্ত্বেও খড়্গপুরের পথঘাট প্রবীণ মানুষদের চলাফেরার জন্য স্বচ্ছন্দ নয়। তপনবাবু বলছিলেন, “সরকার প্রবীণ নাগরিকদের নানা সুবিধার কথা বলছে। অথচ রাস্তা থেকে বাস, অটো, ট্রেকার— কোথাও প্রবীণদের সুবিধায় বিশেষ কোনও ব্যবস্থা নেই। উল্টে সুযোগ বুঝলেই বয়স্কদের থেকে অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়া হয়। বেপরোয়া বাইকের গতির সঙ্গে লড়ে রাস্তায় চলতে হয় আমাদের।”
খড়্গপুর জুড়েই এমন ভোগান্তির কথা শোনাচ্ছেন বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা। যদিও অনেকের মতে, আগের তুলনায় বদলাতে থাকা শহরে বেড়েছে প্রবীণদের পরিষেবা প্রদানের হার। খড়্গপুর স্টেশনের প্রতিটি প্ল্যাটফর্মে ওঠা-নামার জন্য লিফ্ট চালু হয়েছে। ফুটব্রিজে ওঠার জন্য এসক্যালেটর চালু হয়েছে বোগদা এলাকায়। পুরসভার পক্ষ থেকেও শহরের গলিপথ সংস্কার করা হচ্ছে। বিক্ষিপ্তভাবে কয়েকটি সড়কে ফুটপাথ তৈরি হচ্ছে, বিভিন্ন রাস্তায় জ্বলছে আলো, বিভিন্ন মোড়ে বসেছে হাইমাস্ট ও মিনিমাস্ট বাতিস্তম্ভ। অবশ্য এ সবে সন্তুষ্ট নন প্রবীণরা। কারণ, তাঁদের জন্য বিশেষ কোনও পরিষেবার ব্যবস্থা নেই বলেই অভিযোগ। ফলে, রেল ও পুরসভা, দুইয়ের উপরই জমছে ক্ষোভ।
এখনও পর্যন্ত রেল ও পুরসভার যে পরিকাঠামো রয়েছে তা সর্বসাধারণের ব্যবহারে গড়ে তোলা হয়েছে। প্রবীণ নাগরিকদের কথা ভেবে পরিকাঠামোগত উন্নয়ন হয়নি বলে অভিযোগ। ঝাপেটাপুর, মালঞ্চ, ইন্দা, গোলবাজার, বাসস্ট্যান্ড এলাকার মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশে কোনও সড়কে ফুটপাথ নেই। শুধুমাত্র মালঞ্চর ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের একাংশে ফুটপাথ থাকলেও সেখানে জবরদখলের থাবা। শহরের কোথাও রাস্তা পারাপারের জন্য জেব্রা ক্রসিং নেই। বছর পাঁচেক আগে পুর-উদ্যোগে বিভিন্ন মোড়ে সিগন্যালিং ব্যবস্থা চালু হলেও তা কার্যকর করা হয়নি। অথচ এই সব রাস্তা দিয়েই প্রতিদিন ব্যাঙ্ক, পোস্টঅফিস, বাজারে যাতায়াত করেন প্রবীণ নাগরিকরা। ‘সিনিয়র সিটিজেন’ হয়েও ‘জেনারেশন এক্স’-এর সঙ্গেই পাল্লা দিতে হয় তাঁদের। ঝাপেটাপুর গাইকাটার বাসিন্দা বছর আশির পরাগকান্তি দত্ত হতাশ কণ্ঠে বলেন, “পথে গাড়ির চাপ বাড়ছে। অথচ রাস্তায় জেব্রা ক্রসিং-ফুটপাথ নেই, নেই ট্রাফিক সিগন্যাল। অনেক বড় শহরে ঘুরেছি। সেখানে প্রবীণদের জন্য অনেক ব্যবস্থা। কিন্তু আমাদের শহরে প্রবীণরা যেন ব্রাত্য। পুরসভা ভেবেও দেখে না। এটা বড় বেদনার।”
রেলের টিকিটে সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য ছাড় রয়েছে। অথচ সেই টিকিট কাটতে গিয়ে কাউন্টারে সকলের সঙ্গেই লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হয় প্রবীণদের। লিফ্ট থাকলেও অধিকাংশ সময় তা বন্ধ পড়ে থাকে। বিকল হয়ে যায় এসক্যালেটর। শহরের বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত পোস্টমাস্টার বীরেন মাইতি বলেন, “আমি নানা কাজে ট্রেনে যাতায়াত করি। অনেক বড় স্টেশনে দেখেছি প্রবীণদের জন্য আলাদা বসার জায়গা, শৌচাগার, কাউন্টারে আলাদা লাইন থাকে। কিন্তু খড়্গপুরের মতো বিশ্বমানের স্টেশনে সে সবের বালাই নেই।’’
পুরপ্রধান প্রদীপ সরকার অবশ্য বলেন, “আমরা প্রবীণদের জন্য নানা পরিকল্পনা করছি। ইতিমধ্যেই ইন্দা, পুরাতনবাজার-সহ বিভিন্ন সড়কে ফুটপাথের জন্য প্রস্তাব দিয়ে রাজ্য সরকারের অনুমোদনের জন্য পাঠিয়েছি। তাছাড়া শহরে প্রবীণদের চলাফেরায় সুবিধায় পাথওয়ে তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy