Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

হোমে আপত্তি, বিয়েতেই আস্থা নির্যাতিতার মায়ের

চোদ্দোর কোঠা পেরিয়েই প্রেমে পড়েছিল মেয়েটি। প্রতিবেশী যুবকের কথায় ভুলে বিয়ের স্বপ্ন দেখেছিল। রাজি হয়েছিল সহবাসে। কিন্তু সতেরো বছরে অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার সময়ই তার হাত ছেড়েছে ‘প্রেমিক’, সোজা অস্বীকার করেছে বিয়ের কথা। ফলে গর্ভের সন্তানকে নিয়ে নাবালিকা এখন আঁধার ভবিষ্যতের পথে হাঁটছে।

মহকুমাশাসক ও যুগ্ম বিডিও-র সঙ্গে কথা বলছে নাবালিকা। নিজস্ব চিত্র

মহকুমাশাসক ও যুগ্ম বিডিও-র সঙ্গে কথা বলছে নাবালিকা। নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
হলদিয়া শেষ আপডেট: ১৫ জানুয়ারি ২০১৮ ০০:৩৭
Share: Save:

চোদ্দোর কোঠা পেরিয়েই প্রেমে পড়েছিল মেয়েটি। প্রতিবেশী যুবকের কথায় ভুলে বিয়ের স্বপ্ন দেখেছিল। রাজি হয়েছিল সহবাসে। কিন্তু সতেরো বছরে অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার সময়ই তার হাত ছেড়েছে ‘প্রেমিক’, সোজা অস্বীকার করেছে বিয়ের কথা। ফলে গর্ভের সন্তানকে নিয়ে নাবালিকা এখন আঁধার ভবিষ্যতের পথে হাঁটছে।

নতুন করে জীবন শুরু করার পথ রয়েছে মেয়েটির সামনে। প্রশাসন সাহায্যের আশ্বাসও দিয়েছে। কিন্তু বেঁকে বসছে পরিবার। তারা চায় বিয়ে হোক মেয়ের এবং সেই ছেলের সঙ্গেই, যাঁর সন্তান গর্ভে ধরেছে মেয়েটি।

হলদিয়া শহর থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে সুতাহাটার খানপুরের ঘটনা। গত ডিসেম্বরে অন্তঃসত্ত্বা নাবালিকা মহকুমাশাসকের কাছে স্বেচ্ছামৃত্যুর আবেদন জানায়। তারপর থেকেই নড়ে বসেছে পুলিশ-প্রশাসন। শনিবার গ্রেফতার করা হয়েছে অভিযুক্ত যুবকের বাবা বাচস্পতি মণ্ডলকে। কিন্তু খোঁজ মেলেনি মূল অভিযুক্ত সিন্টু মণ্ডলের। রবিবার মেয়েটির বাড়ি গিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেন হলদিয়ার মহকুমাশাসক পূর্ণেন্দু নস্কর, সঙ্গে ছিলেন সুতাহাটার যুগ্ম-বিডিও প্রিয়াঙ্কা মণ্ডলও। নাবালিকাকে তাঁরা সরকারি হোমে গিয়ে থাকা প্রস্তাব দেন। সেখানে নতুন করে লেখাপড়া শুরু করতে পারবে সে। সঙ্গে থাকবে বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও। ফলে ভবিষ্যতে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে সে।

প্রিয়াঙ্কা জানান, মেয়েটি হোমে থাকতে রাজি হয়েছে। কিন্তু আপত্তি রয়েছে মায়ের। প্রশাসনিক আধিকারিকদের সঙ্গে কথোপকথনের মধ্যেই একটি ফোন আসে নাবালিকার মায়ের কাছে। তারপর তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন, ‘‘মেয়েকে ছাড়া যাবে না।’’

মহকুমাশাসক বলেন, ‘‘মেয়েটি ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। এখন যে পরিবেশে সে রয়েছে, তার চেয়ে ভাল পরিবেশ পাওয়ার অধিকার রয়েছে তার। ভবিষ্যতে যাতে কোনও অসুবিধার মুখোমুখি না হতে হয়, সেটা দেখার দায়িত্ব প্রশাসনের।’’ তাঁর আশ্বাস, ফের মেয়েটির কাউন্সেলিং করা হবে।

মেয়েটি নিজে মুখেই স্বীকার করেছে, অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর পরিবার, প্রতিবেশীদের কাছে অনেক গঞ্জনা শুনতে হয়েছে। সে কথা স্বীকার করেছেন প্রতিবেশীরাও। প্রাথমিক ভাবে মেয়েটিকে দোষী করেছিলেন তাঁরা। তবে এখন পড়শি অর্চনা দাস, মামনি দাসরা খুশি প্রশাসনিক আধিকারিকরা মেয়েটির বাড়ি আসায়। তাঁরা বললেন, ‘‘ওরা খুব গরিব। মেয়েটার অন্যত্র বিয়ে দেওয়ার মতো অবস্থা নেই। সরকারি সাহায্য খুব দরকার।’’ মেয়েটির পরিবার অবশ্য অনড় অভিযুক্তের সঙ্গেই মেয়ের বিয়ে দেওয়ায়। তারা চান পুলিশ-প্রশাসন উদ্যোগী হয়ে ওই ছেলেকে ধরে এনে বিয়ে দিক।

তবে পাড়ায় অভিযুক্ত সিন্টুর ‘বদনাম’ যথেষ্ট। স্থানীয় বাবুলাল দাস বলেন, ‘‘বহু মেয়ের সঙ্গেই ওই ছেলের সম্পর্ক রয়েছে। বিয়ে হলেও যে মেয়েটি ভাল থাকবে, এমন কথা বলতে পারি না। সিন্টুর শাস্তি হওয়াই উচিত।’’

শেষ পর্যন্ত মহকুমাশাসক মেয়েটির সুচিকিৎসার বন্দোবস্ত করতে বলেছেন সুতাহাটা ব্লকের চাইল্ড ডেভলপমেন্ট অফিসার পুরুষোত্তম মণ্ডলকে। খারিজ করা হয়েছে কিশোরীর স্বেচ্ছামৃত্যুর আবেদনও। স্থানীয় বাসিন্দারা অবশ্য অভিযোগ করছেন, পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার ফলেই গ্রেফতার করা যাচ্ছে না অভিযুক্তকে। এমনকী নাবালিকার জ্যাঠা অভিযোগ করেছেন, প্রথমবার থানায় লিখিত অভিযোগ জানাতে গেলে মাছি তাড়ানোর মতো করে তাঁদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

যদিও গোটা ঘটনায় উঠছে অন্য প্রশ্নও। যেখানে প্রশাসন মেয়েটির দায়িত্ব নিতে চাইছে, সেখানে কেন তার আপনজনেরা চাইছেন অভিযুক্ত যুবকের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে? অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পরও কেন আট মাস তারা কোনও পদক্ষেপ করেননি? নাবালিকার সুস্থ জীবনের পক্ষে তার নিজের পরিবারই কি বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে না?

রাজ্য মহিলা কমিশনের চেয়ারপারসন লীনা গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘‘মেয়েটি উপযুক্ত পরিবেশে বেড়ে ওঠারই সুযোগ পায়নি, বোঝা যাচ্ছে তার পরিণতি দেখে। তাই সবার আগে তার পরিবারের কাউন্সেলিং প্রয়োজন। শুধু তো নাবালিকা নয়, তার আগামী সন্তানের কথা ভেবেও মায়ের উচিত মেয়েকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে দেওয়া।’’ লীনার দাবি, ‘‘যেখানে একের পর এক নাবালিকা নিজের উদ্যোগে নিজেদের বিয়ে আটকে দিচ্ছে, সেখানে এই মেয়েটির মা সব প্রশাসনিক সাহায্য পাওয়ার পরও কেন তা নিতে অস্বীকার করছেন, সেটাই ভাবনা! এখনও সমাজিক লজ্জা ঢাকতে বিয়েই একমাত্র পথ বলে মনে করা হচ্ছে। এটা ঠিক নয়।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Molestation Minor Girl Marriage Home
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE