Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

কাঁটাতার ছুঁয়ে স্মৃতি হাতড়াচ্ছেন ওঁরা

ফোন রাখার আগের ওই কথাটা মনে পড়ছিল তাঁর, ‘‘কত বছর পরে তোর সঙ্গে দেখা হবে বল তো!’’ অপেক্ষায় ছিলেন হোগলবেড়িয়ার বাউসমারির বাসিন্দা, বছর সত্তরের ইসমাইল বিশ্বাস। আর যাঁর জন্য অপেক্ষা করছিলেন, সেই নাসিরুদ্দিন বিশ্বাসের বাড়ি বাংলাদেশের কুষ্টিয়া। বয়স নব্বই ছুঁইছুঁই।

পুনর্মিলন: রবিবার জলঙ্গিতে। নিজস্ব চিত্র

পুনর্মিলন: রবিবার জলঙ্গিতে। নিজস্ব চিত্র

কল্লোল প্রামাণিক
করিমপুর শেষ আপডেট: ০৬ নভেম্বর ২০১৭ ০১:৩২
Share: Save:

বাংলাদেশ থেকে ফোনটা আসার পর থেকেই বড় অস্থির হয়ে পড়েছিলেন তিনি। মাঝে কেটে গিয়েছে বিয়াল্লিশটা বছর। অথচ এই সাতটা দিন যেন তাঁর কাটতেই চাইছিল না। মনে হচ্ছিল, এ যেন অনন্ত সময়।

ফোন রাখার আগের ওই কথাটা মনে পড়ছিল তাঁর, ‘‘কত বছর পরে তোর সঙ্গে দেখা হবে বল তো!’’ অপেক্ষায় ছিলেন হোগলবেড়িয়ার বাউসমারির বাসিন্দা, বছর সত্তরের ইসমাইল বিশ্বাস। আর যাঁর জন্য অপেক্ষা করছিলেন, সেই নাসিরুদ্দিন বিশ্বাসের বাড়ি বাংলাদেশের কুষ্টিয়া। বয়স নব্বই ছুঁইছুঁই। শুক্রবার রাতে বাংলাদেশ থেকে করিমপুরে এসেছেন নাসিরুদ্দিন। শনিবার তিনি গিয়েছিলেন শিকারপুরে, করিমপুর ১ বিডিও অফিসে। সেখানেই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে ছুটে এসেছিলেন বাউসমারির বাসিন্দা, প্রাক্তন স্কুলশিক্ষক ইসমাইল বিশ্বাস।

এত দিন পরে দেখা! কেঁদে ফেললেন দু’জনেই। সেই দৃশ্য দেখে কিছুক্ষণের জন্য হলেও থমকে গিয়েছিলেন আশপাশের লোক। নাসিরুদ্দিন বলছেন, ‘‘ইসমাইল ভাইঝির ছেলে। দেশভাগের আগে নিয়মিত যাতায়াত ছিল দুই পরিবারের মধ্যে। তখনই শেষ দেখা হয়েছিল ইসমাইলের সঙ্গে। তার পরে চিঠি ও ফোনে যোগাযোগ ছিল। কিন্তু ওঁদের সঙ্গে যে আবার কখনও দেখা হবে তা ভাবিনি।’’

ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে চেকপোস্ট বা স্থলবন্দর তৈরি করে সড়কপথে যোগাযোগের প্রস্তাব নিয়ে বাংলাদেশের কুষ্টিয়া থেকে ১৩ সদস্যের একটি জনপ্রতিনিধি দল করিমপুরে এসেছে। কুষ্টিয়া জেলার প্যানেল চেয়ারম্যান নাসিরুদ্দিন বিশ্বাস সেই দলের অন্যতম সদস্য। এই দেশে আসার আগে তাই ফোন করেই নাতিকে খবরটা জানিয়েছিলেন নাসিরুদ্দিন। ওই বৃদ্ধের কথায়, ‘‘প্রায় বিয়াল্লিশ বছর পরে ইসমাইলকে দেখলাম। এখন ক’দিন ইন্ডিয়ায় আছি। এই ক’দিন কাজের ফাঁকে পুরনো বন্ধু ও আত্মীয়দের বাড়ি গিয়ে সবার সঙ্গে দেখা করব। এর পরে হয়তো আর এ দেশে আসতে পারব না। বাকি জীবনটা এই স্মৃতিটুকু নিয়েই বেঁচে থাকব।”

ইসমাইল বিশ্বাসও বলছেন, ‘‘খুব ছোট থেকেই এই দাদুর কোলে-পিঠে চেপেই বড় হয়েছি। মাঝে মাঝে ফোনে কথা হতো। কিন্তু নানাকে এ ভাবে দেখতে পেয়ে ছেলেবেলার দিনগুলো বড্ড মনে পড়ে যাচ্ছে। নানাকে বাড়িতে আসার কথা বলেছি। নানাও কথা দিয়েছেন।’’ বাংলাদেশ থেকে আসা প্রতিনিধি দল করিমপুরের যে হোটেলে থাকছেন, সেখানেও দিনভর ভিড়। খবর পেয়ে তাঁদের এ দেশের আত্মীয়েরা ছুটে আসছেন দেখা করতে। রবিবার সকালে ভগ্নীপতি ইমরান চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন হোগলবেড়িয়ার হরেকৃষ্ণপুরের রাহুল মণ্ডল। প্রায় আট বছর আগে ইমরানের বিয়ে হলেও এই প্রথম তিনি শ্যালকের দেখা পেলেন। ইমরান বলছেন, “শ্বশুরবাড়ি বাংলাদেশে। কিন্তু স্ত্রী-র মাসির বাড়ি এ দেশে। বিয়ের পর থেকে স্ত্রী ও শ্বশুরবাড়ির কাছে এ দেশের গল্প শুনেছি। শ্যালকের সঙ্গে এ দিন প্রথম দেখা হল। সে কথা ফোনে বাড়িতেও জানিয়েছি।”

রাহুলের কথায়, “মায়ের মুখে ওঁদের কথাও খুব শুনেছি। কিন্তু ভিসা-পাসপোর্ট করে আজও বাংলাদেশে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। ভগ্নীপতির মোবাইলে বোনের ছোট ছোট দুই মেয়ে ও মাসির বাড়ির সকলের ছবি দেখে খুব আনন্দ হচ্ছে। ভগ্নীপতিকে কথা দিয়েছি, খুব তাড়াতাড়ি পাসপোর্ট করে বাংলাদেশে যাব।”

বাবার পুরনো বন্ধুর বাড়ি হোগলবেড়িয়ার রাজাপুর ও জলঙ্গির বেশ কিছু বাড়িতে যাবেন প্রাগপুরের সহিদুল হালসানা। তিনি জানান, দেশভাগের আগে কানাই সরকার ছিলেন তাঁদের পড়শি। ১৯৭১ সালে তিনি রাজাপুরে চলে আসেন। সেই সময় তাঁদের সমস্ত মালপত্র সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিলেন সহিদুলের বাবা। তার পরেও কিছু দিন কানাই চাচার সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ ছিল। দুই পরিবারের মধ্যে যাতায়াত ছিল। পরে সীমান্তের কড়াকড়িতে সে সব বন্ধ হয়ে যায়। সহিদুলের কথায়, ‘‘বেশ কয়েক বছর আগে বাবা মারা গিয়েছেন। কানাই চাচাও আছেন কি না জানি না। কিন্তু এ দেশে যখন এসেছি, এক বার হলেও তাঁর বাড়িতে যাব। জলঙ্গির বিদুপুরে আত্মীয় আছে। সাহেবরামপুরে আছেন পারিবারিক বন্ধু নজরুল ইসলাম। সেখানেও যাব।’’

আকুতির কথা সীমান্ত জানে। কাঁটাতার জানে প্রাণের টান। আর জানে বলেই দশমীর বিকেলে মাথাভাঙার দু’পাড়ে থিকথিক করে ভিড়। ইদের দুপুরের অপেক্ষায় থাকে পাকশি, ব্রজনাথপুর। সীমান্তের অনুশাসনে ফি বছর দেখা হয় না। তবুও অপেক্ষায় থাকে দুই বাংলা। তাই কাজের সূত্রে ‘ইন্ডিয়া’ এসে শুধু কাজ করে যাওয়াটাই কাজের কথা নয়। চেকপোস্ট হবে কি না, তা সময় বলবে। কাজের ফাঁকে হঠাৎ দেখা হওয়া সম্পর্কের সুতোগুলোকে সবুজ করে রাখবে। সেটাও কি বড় প্রাপ্তি নয়?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Karimpur করিমপুর Bangladesh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE