Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

গাঁয়ের মাচা থেকে সোশ্যাল দেওয়াল, ছুটছে শুধুই ‘উন্নয়ন’

সেই ‘সংঘর্ষ’-এর জন্য কে বা কারা দায়ী তা-ই নিয়ে আলোচনা। তর্ক, পাল্টা তর্কে উত্তেজনার পারদ তখন ঊর্ধ্বমুখী।

নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব চিত্র।

অনল আবেদিন
বহরমপুর শেষ আপডেট: ১৬ মে ২০১৮ ০০:২৮
Share: Save:

ভোটের পর দিন। নিমগাছের তলায় বিশাল বাঁশের মাচা। সেখানে হাজির সব দলের কর্মী-সমর্থকেরা। চলছে জোর আলোচনা।

ভোটের দিন কেউ কেউ মারধর খেয়েছেন। সেই ‘সংঘর্ষ’-এর জন্য কে বা কারা দায়ী তা-ই নিয়ে আলোচনা। তর্ক, পাল্টা তর্কে উত্তেজনার পারদ তখন ঊর্ধ্বমুখী।

তাতে উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন কংগ্রেস কর্মী সাফাতুল্লা। হঠাৎ কংগ্রেসেরই বুথ এজেন্ট সহিদুল মোল্লার তাঁর পিঠে হাত রাখলেন। বললেন, ‘‘ছাড় তো ও সব কথা। যা হওয়ার সে তো গতকাল বিকেলেই মিটে গিয়েছে। ভোট শেষ হতে রাত ৯টা বেজে গিয়েছিল। আমার বাড়ি তো গাঁয়ের এক কোনায়। যেতে খানিক ভয়ও করছিল। সিপিএমের বুথ এজেন্ট আসিফ শেখই তো আমায় এগিয়ে দিল। তিন ব্যাটারি টর্চ জ্বালিয়ে বাঁশবাগান, আমবাগান পার করে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল। তা না হলে কী বিপদেই না পড়তাম বল তো?’’

মাচায় হাজির ছিলেন আসিফও। তিনি বলেন, ‘‘তোরা তো ভোট শেষ হতে যে যেমন পারলি কেটে পড়লি। আমি না থাকলে ওই আঁধারে সহিদুল চাচার মতো বুড়ো মানুষটা অতটা পথ পার হয়ে কী ভাবে বাড়ি যেত তা কেউ ভেবে দেখেছিস? কাল মাথা গরমের ফলে যা হওয়ার হয়েছে। এখন ও সব ভুলে যা।’’

গত সোমবার ছিল পঞ্চায়েত ভোট। এ আলোচনা সেই ভোটকে ঘিরে নয়। কয়েক দশক আগে এক বিধানসভা ভোটকে ঘিরে, সাবেকি বহরমপুর (বর্তমানে দৌলতাবাদ) থানার মদনপুরের সরসাবাদ গ্রামের মানুষের।

বিয়ে হয়ে অন্য গ্রামে চলে যাওয়া এক মহিলার হয়ে ভুয়ো ভোট দেওয়া নিয়ে তুমুল ঝামেলা হয়েছিল। সেই মাচায় বসেই সকলে ঠিক করলেন, ‘‘আমাদের পাশাপাশি বাস, পাশাপাশি চাষ। গতকালের বিবাদ গতকালেই থাক। কংগ্রেস, সিপিএম, এসইউসি, মুসলিম লিগ সবাইকে মিলেমিশে চলতে হবে। এটাই মানুষের কাজ।’’

এ কথা ঠিক, প্রায় পাঁচ দশক আগের সেই সংস্কৃতি আজ ততটা নেই। ভাটার ছাপ স্পষ্ট মাচা বা মুদির দোকানে সর্বদলীয় আড্ডাতেও। কিন্তু একটা সময় ছিল মাচা আর মুদির দোকানের আড্ডাটাই ছিল গ্রামের লোকজনের কাছে ছিল স্থানীয় ‘বিধানসভা’ বা ‘পার্লামেন্ট’! রোজ বিকেলে ছেলে বুড়োরা এসে মাচায় জড়ো হতেন। ঘণ্টার ঘণ্টার ধরে চলত চর্চা। মাচা সংস্কৃতি হয়তো কোথাও কোথাও টিকে আছে। চায়ের দোকানে বসে আড্ডাও। তবে এই সময়ে ভোটচর্চার একটা বড় মাধ্যম সোশ্যাল মিডিয়া। ফলে এ যুগে ভোট হিংসার বিবর্তনের সঙ্গে বদলেছে তা নিয়ে চর্চার চরিত্রও।

গত সোমবার নওদার দক্ষিণ শ্যামনগর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পোলিং অফিসার ছিলেন অর্ণব দাস। তাঁকে নিয়ে কলেজের অধ্যক্ষ সুজাতা বন্দ্যোপাধ্যায় মঙ্গলবার ফেসবুকে লেখেন, ‘‘বুথের ভিতর আহত ভোটকর্মী অর্ণব দাস কৃষ্ণনাথ কলেজের শিক্ষক। মাথায় দশটি সেলাই।’’ অধ্যক্ষ সুজাতা বন্দ্যোপাধ্যায় গত বিধানসভা ভোটে বহরমপুর কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের হয়ে প্রতিদ্বিতা করে হেরে গিয়েছেন। তাঁর ওই লেখায় মন্তব্য করতে গিয়ে ওই ওয়ালেই জিয়াগঞ্জ কলেজের অধ্যক্ষ অজয় অধিকারী লিখেছেন, ‘‘অর্ণবের মাথায় কাল উন্নয়নের স্নেহ চুম্বন বর্ষিত হয়েছে।’’

লালগোলার লস্করপুর হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক জাহাঙ্গির আলম মঙ্গলবার ফেসবুকে লিখেছেন, ‘‘ভোট গ্রহণ করতে ভগবানগোলা ১ নম্বর ব্লকে গিয়েছিলাম। ১৮ বছরের চাকরি জীবনে এত সুন্দর ভোট নেওয়ার অভিজ্ঞতা কোনও দিন হয়নি। কোনও ঝামেলা নেই। ভোট দিতে আসা মানুষের লাইন নেই। এজেন্টদের বসার জায়গা নাই। শুধু ভোট আর ভোট। এত মসৃণ ভোট কোনও দিন দেখিনি। দুপুর ১২টার মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগ ভোটগ্রহণ শেষ।’’ ওই লেখায় মন্তব্য করেছেন লালগোলা এমএন অ্যাকাডেমির শিক্ষক জিয়াউর রহমান। লিখেছেন, ‘‘১২টার মধ্যে ৮০ শতাংশ? তুমি দেখছি উন্নয়নের সাক্ষাত দেখা পেয়েছ!!’’

দিন বদলায়। বদলায় ভোটচর্চা। বদলায় ভোট পরবর্তী চর্চাও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

West Bengal Panchayat Election 2018
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE