নিমন্ত্রণ: মাধ্যমিক ভোজের আমন্ত্রণপত্র। নিজস্ব চিত্র
শেষ ফাগুনের হাওয়ায় দুলছে পেল্লাই সামিয়ানা। নীচে আমন্ত্রিতদের বসার জন্য আনানো হয়েছে শ’খানেক চেয়ার। পাশে বিরাট উনুনে বসানো হাঁড়িতে ফুটছে দিশি মুরগির মাংস।
শনিবার দিনভর ব্যস্ততার শেষ নেই বাড়ির কর্তা রজব আলির। পেশায় রাজমিস্ত্রির জোগাড়ে রজব বলছেন, ‘‘বাড়ির বড় ছেলে এ বার মাধ্যমিক দিচ্ছে। সেই উপলক্ষেই এই আয়োজন। কোথাও কোনও ত্রুটি থাকলে যে মান থাকবে না!’’
এ যদি মুর্শিদাবাদের ভগবানগোলার ছবি হয়, তা হলে পদ্মাপাড়ের লালগোলায় সারজেমান শেখের বাড়িতেও এলাহি ব্যাপার। রবিবার সেখানে আমন্ত্রিত ছিলেন শ’দেড়েক অতিথি। পাতে পড়েছে চিকেন বিরিয়ানি।
মোটরবাইক শো-রুমের মালিক সারজেমান হাসছেন, ‘‘বড় ছেলের মাধ্যমিক তো। তাই সামান্য এই আয়োজন। ছেলেটারও ভয় ভাঙল। উপরিপাওনা, অতিথিদের দোয়া।’’ আমন্ত্রিতরাও পরীক্ষার্থীদের উপহার হিসেবে দিয়েছেন পেন-খাতা-বই।
সীমান্ত ঘেঁষা লালগোলা, ভগবানগোলা, ফরাক্কা কিংবা লালবাগের মতো জনপদে এমন রেওয়াজ অবশ্য নতুন নয়। লালগোলা লস্করপুর উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের প্রধানশিক্ষক জাহাঙ্গির আলম বলছেন, ‘‘মাধ্যমিকের আগে সকলেই দুশ্চিন্তায় থাকেন। এমন আয়োজনে ভয় ঢাকা পড়ে যায় উৎসবের আবহে।’’
রজব আলি প্রাথমিক স্কুলের চৌকাঠ পেরোতে পারেননি। স্ত্রী রূপসেনা বিবির দৌড় ক্লাস সেভেন পর্যন্ত। বড় ছেলে সামিম শেখ বাড়ির মধ্যে প্রথম মাধ্যমিকে বসছে। অনেক আগে থেকে এই দিনটার জন্য টাকা জমাচ্ছিলেন রজব। মুখে নয়, রীতিমতো আমন্ত্রণপত্র ছাপিয়ে বিলি করেছেন তিনি। ভালয় ভালয় সব মিটে যাওয়ার পরে গর্বিত রজব বলছেন, ‘‘সবাই দোয়া করুন, ছেলেটা যেন সফল হয়।’’
আর সারজেমান বলছেন, ‘‘আমার বাবা ছিলেন কাঠুরে। তিনি কষ্ট করে আমাকে বি কম পাশ করিয়েছেন। আর আমার ছেলে আরিফ জামানের জন্য এটুকু করব না?’’
সীমান্ত ঘেঁষা জনপদ হওয়ার সুবাদে পাচার, হেরোইন কিংবা জাল টাকার কারবারে বহু বার উঠে এসেছে লালগোলা কিংবা ভগবানগোলার নাম। তবে স্থানীয় স্কুলের শিক্ষকেরা জানাচ্ছেন, সেই আঁধার ক্রমে মুছে দিচ্ছে পড়ুয়ারা। গত কয়েক বছরে বেড়েছে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়েছে ছাত্রীর সংখ্যা। এই জেলা থেকে এ বছর মাধ্যমিক দিচ্ছে ৮৬ হাজার ৩৩৩ জন। তাদের মধ্যে ছাত্রীর সংখ্যা ৫৩ হাজার ১৯৬।
লস্করপুরের প্রধানশিক্ষক জাহাঙ্গির আলম জানান, দারিদ্র, ভৌগোলিক অসুবিধার মতো নানা বাধা ডিঙিয়ে সীমান্তের ছাত্র-ছাত্রীরা যে ভাবে উঠে আসছে, তা কুর্নিশ করার মতো। অন্যদের কাছে মাধ্যমিক স্রেফ একটা পরীক্ষা হলেও তাঁদের কাছে এটা যুদ্ধ। সেখানে হেরে গেলে ফের জমাট বাঁধবে অন্ধকার। পরীক্ষার আগে এই ভোজের মাধ্যমেই ছেলেমেয়েদের জয়ের খিদেটা আরও বাড়িয়ে দেওয়া হয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy