Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
সাতপাকের সাতকাহন/৩

দু’শো সাত রকম পদ বিয়ের মেনু কার্ডে

আবার তারা আসিছে ফিরিয়া। বাহন থেকে পাত, বাজিমাত করতে আজও সেই সব পুরনো জিনিসের জুড়ি মেলা ভার। বিয়ের রকমারি গল্প শুনল আনন্দবাজার। আবার তারা আসিছে ফিরিয়া। বাহন থেকে পাত, বাজিমাত করতে আজও সেই সব পুরনো জিনিসের জুড়ি মেলা ভার। বিয়ের রকমারি গল্প শুনল আনন্দবাজার।

অনল আবেদিন ও দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০০:৩৫
Share: Save:

সময়টা ১৯০৬। একদিকে বিপ্লবী আন্দোলনের জনসমর্থন বাড়ছে হু হু করে। অন্য দিকে, দৈনন্দিন জীবনের নানা ক্ষেত্রে প্রগাঢ় হচ্ছে পশ্চিমী প্রভাব। দ্রুত বদলাচ্ছে সব কিছু। বাঙালির চিরায়ত সামাজিক উৎসব-অনুষ্ঠানে লাগছে সাগরপাড়ের হাওয়া। এমন এক সময়ে কলকাতায় কুমার রামেন্দ্রকৃষ্ণ দেব তাঁর বড় ছেলের বিয়েতে আয়োজন করলেন এক অভিনব ভোজের। বরকর্তা ব্রিটিশ স্নেহভাজন ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট। ছেলে কেশবেন্দ্রকৃষ্ণও বিলেত ফেরত আইনজীবী। এহেন ‘হাই প্রোফাইল’ বিয়ের ভোজে আমন্ত্রিতদের পাতে ৩৬ রকমের পদ দিয়ে চমকে দিয়েছিলেন ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব। কিন্তু সেই পদের সংখ্যার থেকেও আলোচনার বিষয় হয়ে উঠল অন্য একটি জিনিস। ষোড়শব্যঞ্জনে অতিথি আপ্যায়ন ছিল সে কালের চালু রীতি। কিন্তু কী কী পদ পরিবেশন করা হবে, তা ভোজের আগে কাকপক্ষীতেও টের পেত না। গোপনীয়তা ছিল ভোজের আর এক আকর্ষণ।

কেশবেন্দ্রের বিয়ের ভোজে গোপনীয়তার বেড়াজাল উড়িয়ে দিলেন রামেন্দ্রকৃষ্ণ। অভ্যাগতেরা ভোজের পাতে বসার আগেই হাতে পেয়ে গেলেন দু’টো করে ‘মেনুকার্ড’। বাংলায় ছাপানো মেনুকার্ডে ছিল ৩৬ রকমের পদ। আর ফরাসি ভাষায় ছাপানো মেনুকার্ডে বিদেশি অভ্যাগতদের জন্য ছিল ১৬ রকমের পদ। পদ্মলুচি, হোসনি কাবাব, সন্ধানিকা, এক ডজন মিষ্টির পদ তো ছিলই। ভরা বর্ষায় সাহেবদের পাতে ইলিশ দিতেও ভোলেননি গৃহকর্তা।

যত দূর জানা যায়, বাংলায় ভোজের আসরে মেনুকার্ড প্রথম দেখা গিয়েছিল জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে। সৌজন্যে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চতুর্থ পুত্র হেমেন্দ্রনাথের মেজ মেয়ে প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী। ঠাকুরবাড়ির এই কন্যাকে সবথেকে বেশি টেনেছিল রান্নাঘর। রন্ধনতত্ত্বে তাঁর দক্ষতা ছিল নজিরবিহীন। প্রজ্ঞাদেবী ভোজসভায় বাংলায় প্রথম মেনুকার্ড হাজির করেন। তার বাংলা করলেন ‘ক্রমণী’। বিলেতের রাজকীয় ভোজসভায় প্রচলিত মেনুকার্ড থেকেই অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন তিনি। শুরুতে সুন্দর করে হাতে লেখা ক্রমণী ঠাকুরবাড়ির ভোজের আসরে ঝুলিয়ে দেওয়া হত। পরে হাতে হাতে ছাপানো মেনুকার্ড দেওয়ার প্রচলন হয়। উনিশ শতকের প্রথম দিকে এই মেনুকার্ড মূলত ধনীরা ব্যবহার করতেন। বহরমপুরের প্রবীণ গবেষক প্রাবন্ধিক রমাপ্রসাদ ভাস্করের সংগ্রহে রয়েছে একটি ঐতিহাসিক মেনুকার্ড। সালটা ১৯১৭-১৮। কাশিমবাজারের রাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর নাতি শ্রীশচন্দ্রের বিয়েতে নিমন্ত্রিতদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল মেনুকার্ড। পদের সংখ্যা এবং নাম দেখে ভিরমি খাওয়ার উপক্রম। মোট ২০৭ রকমের পদ পরিবেশিত হয়েছিল শ্রীশচন্দ্রের বিয়ের ভোজে।

এখন ভোজের পাতে বসে হাতে মেনুকার্ড না পেলেই অবাক হন লোকজন। মেনুকার্ডের উপাদান থেকে ভাষা সব কিছুতেই অভিনবত্ব খুঁজতে হয়রান ক্যাটারিং কোম্পানির মালিক। মাটি, গাছের ছাল, সুপারির খোলা, কাঁসা-পিতল, কাঠ— হাজারো জিনিসের তৈরি মেনুকার্ডে অভিনব ভঙ্গিতে লেখা খাবারের পদ বিয়ে বাড়ির অন্যতম আকর্ষণ।

নোটবন্দির সময়ে বাতিল পাঁচশো বা হাজার টাকার নোটের অনুকরণে মেনুকার্ড খুব চলেছিল। কাগজের প্রথম পাতার ঢঙে সাজানো মেনুকার্ডে খাদ্য তালিকা লেখা হয়েছিল কাগজের ভাষাতেই। আবার ক্রিকেটের ধারাবিবরণীর মতো ‘ওপেনিং ব্যাটসম্যান মটরশুঁটির কচুরি ও মটরপনির...’ বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। অদ্বৈতভূমি শান্তিপুরের একটি বিয়েতে মেনুকার্ড লেখা হয় কীর্তনের ঢঙে। একদা কাঁসা-পিতলের বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র নবদ্বীপের একাধিক বিয়ে বা ভোজের অনুষ্ঠানে পিতলের পাত দিয়ে তৈরি পানপাতার উপর মেনুকার্ড চোখে পড়ছে। শহরের টেরাকোটা শিল্পী তপন রাঢ়ী তাঁর মেয়ের বিয়ের মেনুকার্ড করেছিলেন পোড়ামাটির গণেশে। কয়েক বছর আগে নবদ্বীপেই বিয়ের মেনুকার্ড তৈরি হয়েছিল একটি চমৎকার হাতপাখার আদলে। হাতপাখা খুললেই ভেসে উঠছে ফিস কাটলেট, পাবদা, ফ্রায়েড রাইস।

(চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Zamindars Menu cards Marriage party
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE