Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

চোখের সামনেই জ্বলে গেলেন ওঁরা

জাতীয় সড়কের পাশেই আলুর খেতে কাজ করছিলাম। সঙ্গে বাবা আর ভাই। হঠাৎই বিকট শব্দ শুনে রাস্তার দিকে চোখ ফেরাতেই দেখি, একটা ট্রাক ঘষটে নিয়ে যাচ্ছে একটা অ্যাম্বুল্যান্সকে। ধাক্কায় অ্যাম্বুল্যান্সটা দুমড়ে গিয়েছে।

উদ্ধার করতে গিয়ে ফোস্কা পড়ল হাতে। নিজস্ব চিত্র

উদ্ধার করতে গিয়ে ফোস্কা পড়ল হাতে। নিজস্ব চিত্র

প্রবীর মণ্ডল
মথুরাপুর শেষ আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০১৭ ০২:৩৭
Share: Save:

তখন বেলা বড় জোর সওয়া ১১টা।

জাতীয় সড়কের পাশেই আলুর খেতে কাজ করছিলাম। সঙ্গে বাবা আর ভাই। হঠাৎই বিকট শব্দ শুনে রাস্তার দিকে চোখ ফেরাতেই দেখি, একটা ট্রাক ঘষটে নিয়ে যাচ্ছে একটা অ্যাম্বুল্যান্সকে। ধাক্কায় অ্যাম্বুল্যান্সটা দুমড়ে গিয়েছে।

আমাদের জমি থেকে প্রায় তিরিশ মিটার দূরে রাস্তার পাশে গিয়ে ট্রাকটা থেমে গেল। ইতিমধ্যে অ্যাম্বুল্যান্স থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে, আগুন লেগে গিয়েছে পেট্রোল ট্যাঙ্কে। আমরা তিন জন দৌড়লাম। খানিক দূরের জমিতে ছিল খোকন। সে-ও ছুটে আসে লাঠি হাতে। গিয়ে দেখি, অ্যাম্বুল্যান্সের সব গেট লক করা। চালকের কোনও সাড় নেই। পিছনে দুই তরুণী আর এক তরুণ। লাঠি দিয়ে দরজার হাতলে মেরেও খোলা গেল না। শেষে রাস্তার ধার থেকে পাথর তুলে মারলাম জানলার কাচে। কাঁচ ভেঙে পড়তেই পাথর ঠুকলাম লকে।

দরজা খুলে যেতেই হেলে থাকা এক তরুণীর অচৈতন্য দেহ ঝুলে পড়ল। গা তেতে রয়েছে। বাবা আর আমি ধরাধরি করে তাঁকে বের করে আনলাম। পাশ দিয়ে হুশ-হুশ করে গাড়ি চলে যাচ্ছে রঘুনাথগঞ্জের দিকে। আমরা হাত তুলে থামাতে চাইচি, কেউ থামছে না। একটা লছিমনও চোখে পড়ছে না। বিশ-পঁচিশ মিনিট কেটে যাওয়ার পর হঠাৎ দেখি, একটা অ্যাম্বুল্যান্স ফিরছে বহরমপুর থেকে। তরুণীতে তাতেই তুলে দিয়ে বললাম জঙ্গিপুর হাসপাতালে নিয়ে যেতে। অ্যাম্বুল্যান্সের পিছনে মোটরবাইকে এক যুবক আসছিলেন। নাম জয়নাল আবেদিন, যাবেন কালিয়াচক। তিনি বললেন, ‘আপনারা এখানে সামলান, আমিই অ্যাম্বুল্যান্সের সঙ্গে যাচ্ছি।’

নিরুপায়: গাড়িতে জলজ্যান্ত মানুষকে পুড়তে দেখেও কাছে ঘেঁষতে পারলেন না কেউই। শুক্রবার মথুরাপুরের কাছে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কে। ছবি: অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়

অন্যরা ততক্ষণে বাকিদের বের করার চেষ্টা করছে। তখন ভিতরেও আগুন জ্বলতে শুরু করেছে। সিটে বসা এক তরুণী ও এক তরুণ তখনও নড়ছেন। কিন্তু কথা বলার অবস্থায় নেই। তরুণীটি যেন হাত বাড়ানোর চেষ্টা করলেন। আমরা বারবার চেষ্টা বাড়িয়েও টেনে আনতে পারলাম না। আগুনের প্রচণ্ড হলকা। আমার হাতও যেন ঝলসে যাচ্ছে।

কে যেন ধুলিয়ানে দমকল কেন্দ্রে ফোন করল। পুলিশও চলে এল একটু বাদে। ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। চোখের সামনে পুড়ে গেল তিনটে জ্যান্ত মানুষ! আমাদেরও হাতে ফোস্কা পড়েছে। কিন্তু তাতে কষ্ট নেই। বুকের মধ্যে টনচন করে উঠল, যখন শুনলাম, এত কষ্ট উদ্ধার করা তরুণীটিও মারা গিয়েছেন। শুনলাম, ওঁর নাম রিয়া সাহা। কী জানি, হয়তো একটু আগে হাসপাতালে পাঠাতে পারলে উনি বেঁচে যেতেন!

লেখক ঘটনার প্রতক্ষ্যদর্শী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Accident Death Burnt Truck Ambulance
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE