নরেন্দ্র মোদী তখন মেদিনীপুরের সভায় ঝড় তুলেছেন। কাটা কাটা বাংলায় উদাত্ত কণ্ঠে বলছেন— ‘‘বন্ধুগণ, আমার সরকার, আপনাদের সরকার, কৃষক দরদি সরকার।’ এদিকে, সকাল থেকেই টেলিভিশনে চোখ নদিয়ার ভাগচাষি মহাদেব পালের। শুনতে শুনতেই অস্ফুটে বলে ফেললেন, ‘‘সরকার সত্যিই আমাদের হলে ঋণের বোঝা মাথায় আমাদের মরতে হত না!’’
লোকসভা নির্বাচনের আগে চাষিদের মন পেতে প্রধানমন্ত্রী যতই কৃষি কল্যাণ সমাবেশ করুন না কেন, নদিয়ার কৃষকেরা কিন্তু সন্তুষ্ট নন। তাঁদের ক্ষোভ, সরকার তো প্রকল্প ঘোষণা করেই খালাস! দিন কয়েক আগেই ১৪টি খারিফ শস্যের সহায়ক মূল্য দ্বিগুণ করার সিদ্ধান্ত নেয় কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা। শেষ সাধারণ বাজেটে যা ছিল দেড়গুণ। দেশের জনসংখ্যার ৬০ শতাংশই কৃষির সঙ্গে যুক্ত। অতএব, ভোটের দিকে খেয়াল রেখে কৃষকদের জন্য সরকার যে প্রকল্প ঘোষণা করবে, সেটাই স্বাভাবিক। তবে এর থেকে প্রকৃত লাভ কৃষকেরা কতখানি পাচ্ছেন, তা নিয়ে সংশয় থাকছেই।
কেন্দ্রীয় সংস্থা ন্যাশনাল এগ্রিকালচার কো-অপারেটিভ ফেডারেশন (নাফেড)-এর মাধ্যমে কেন্দ্র ন্যায্যমূল্যে চাষিদের থেকে ফসল কেনে। কয়েক দশক আগে এই সহায়ক মূল্য চালু হয়। এ বছর ফসল লাগানোর আগে তা দ্বিগুণ করার ঘোষণা হয়েছে। আশা, এর ফলে হয়তো চাষিরা উৎসাহিত হবেন। দেশে খাদ্যশস্যের ফলন বাড়বে।
কিন্তু উৎপাদিত ফসল আদৌ সহায়ক মূল্যে বিক্রি করা যাচ্ছে কী?
নাফেডের এক কর্তা জানাচ্ছেন, সরকার উৎপাদিত ফসলের পুরোটাই কেনে না। ২০ শতাংশ ন্যায্যমূল্যে কেনে সরকার। বাকি ৮০ শতাংশ ফসলই চাষিকে কম দামে বেচতে হয়। অনেক সময় প্রচারের অভাবে চাষিরা জানতেই পারেন না। নাকাশিপাড়ার প্রতিষ্ঠিত চাষি আনন্দ বিশ্বাস যেমন বলছেন, ‘‘ও সব সহায়ক মূল্য কাগজেই পড়ি। বাস্তবে কিছু হয় না।’’
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, জেলার প্রায় ৩০ লক্ষ লোক চাষবাসের সঙ্গে জড়িত। ২ লক্ষ ৭২ হাজার হেক্টর জমিতে চাষ হয়। এর মধ্যে একটা বড় সংখ্যক অংশ ভাগচাষি বা চুক্তিভিত্তিক চাষি। কেউ এককালীন মোটা টাকার বিনিময়ে জমি বন্ধক নিয়ে ফসল ফলান। তাঁরা কিষাণ ক্রেডিট কার্ড (কেসিসি) পাননি। কৃষি দফতরের দাবি, জেলার প্রায় ৪ লাখ চাষি কিষাণ ক্রেডিট কার্ড পেয়েছেন। পরিসংখ্যান থেকেই স্পষ্ট, বড় সংখ্যক চাষি এই কার্ড পাননি। এই কার্ড থাকলে চাষিকে মহাজনের থেকে চড়া সুদে ঋণ নিতে হত না।
নাকাশিপাড়ার চ্যাঙ্গা গ্রামের চাষি সরিফুল শেখ জানাচ্ছেন, এক সময় ভাগচাষিরা গোষ্ঠী তৈরি করলে সেই গোষ্ঠীকে ব্যাঙ্ক চাষের জন্য ঋণ দিত। এখন আর তা পাওয়া যায় না। এখন যাঁর নামে জমির রেকর্ড রয়েছে, সেই চাষিই কেসিসি-র মাধ্যমে ঋণ পাচ্ছেন। অথচ, জমি রেকর্ড করার প্রক্রিয়াও বেশ জটিল। ধুবুলিয়ার চাষি সহেল শেখের অভিজ্ঞতা, ‘‘এক বছর হল, একটা জমির রেকর্ড করার জন্য আবেদনপত্র জমা দিয়েছি। এখনও অবধি তা হাতে পাইনি!’’
চাষিদের অভিযোগের তালিকা দীর্ঘ। প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনাও সব ফসলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। ধান-পাটের মতো কয়েকটি ফসল নষ্ট হলেই মেলে বিমার টাকা। আর যে সব চাষি ঋণ নিয়ে চাষ করছেন, তাঁরাই সে সুবিধা পান।
অন্য দিকে, ফসলের ক্ষতি মাপা হয় পঞ্চায়েত ধরে, কিছু ক্ষেত্রে ব্লক ধরে। ঘূর্ণি ঝড়ে মৌজার ফসলের ক্ষতি হলে নিয়মের গেরোয় পড়ে ক্ষতিপূরণ পান না মৌজা চাষি! আবার, সয়েল হেল্থ কার্ড থাকলে চাষি মাটির স্বাস্থ্য সম্পর্কে জানতে পারেন। অথচ, মাটির নমুনা সংগ্রহ করে ব্লক স্তরের অফিসে দিয়ে আসার এক বছর পরও মেলে
না কার্ড।
এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে জেলা কৃষি দফতরের উপ-অধিকর্তা (প্রশাসন) রঞ্জন রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘কৃষি ক্ষেত্রে নদিয়া জেলা সেরার সেরা। চাষিরা সব
পরিষেবাই পাচ্ছেন।’’
কৃষকসভার নদিয়া জেলার সাধারণ সম্পাদক মেঘলাল শেখ বলেন, ‘‘প্রত্যেক সাধারণ নির্বাচনের আগেই এমন হাজারো প্রতিশ্রুতি শোনা যায়। কৃষকেরা ঠিকমতো ফসলের দাম পান না। পেলে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটত না! মোদীর এসব কথা আসলে ভাঁওতা।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy