দৃষ্টিহীনদের ক্রিকেট ম্যাচের একটি মুহূর্ত। নিজস্ব চিত্র
শব্দ শুনে গুলতি ছুড়ে লক্ষ্যভেদ করা শিখেছিল ধনাই ওঁরাও। একই কায়দায় সে এখন কভার ড্রাইভ শটে বল পাঠায় বাউন্ডারির বাইরে। শুধু কি বল? সেই ছেলেবেলা থেকেই জীবনের সব প্রতিবন্ধকতাকেও একই ভাবে মাঠের বাইরে পাঠিয়ে সে পূরণ করে চলেছে একের পর এক লক্ষ্য। আর সেই কারণেই ডাইভ দিয়ে বাউন্ডারি বাঁচিয়ে ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে ধনাই বলতে পারে, ‘‘এত সহজে আমাকে হারানো যাবে না।’’
দৃষ্টিহীন ধনাই ওঁরাও একা নয়, তার মতো প্রতিটা জেলার ক্রিকেট দলের খেলোয়াড়েরাই বিশ্বাস করে, মনের জোর থাকলে ক্রিকেট কেন, জয় করা যায় একের পর দুর্গম পাহাড়ও। দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র রাজকুমার দাস ব্যাট করতে নেমেছিল মালদহের সুবোধ কুমার মিশ্র মেমোরিয়াল ব্লাইন্ড স্কুলের হয়ে। একের পর এক বাউন্ডারি হাঁকিয়ে যখন সে শতরান পূর্ণ করল, মাঠের বাইরে তখন উচ্ছ্বসিত প্রতিদ্বন্দ্বী স্কুল টিমের খোলোয়াড়েরাও।
কারণ, তারা বিশ্বাস করে, এ সাফল্য একা রাজকুমারের নয়, তাদের সকলের। আসলে বাধা পেরনোর লড়াইয়ে বিপক্ষ কিছু হয় না। সকলেই সহযোদ্ধা। স্কোর বোর্ডের সংখ্যার ক্ষমতা নেই তাদের সেই লড়াইকে আলাদা করে দেওয়ার। মাঠের বাইরে মাইকে ঘোষণা হতেই ব্যাটটাকে আকাশের দিকে তুলে ধরে রাজকুমার। গোটা মাঠ তখন উঠে দাঁড়িয়ে কুর্নিশ করছে রাজকুমারকে। মাঠের বাইরে থেকে তখন বর্ধমান ব্লাইন্ড অ্যাকাডেমির দুই খেলোয়াড় বিল্টু গড়াই আর রিঙ্কু লোহার গলা ফাটাচ্ছে, ‘‘ক্যারি অন রাজকুমার, ক্যারি অন।”
রাজ্যের ১২টি জেলার মোট ১৬টি স্কুল নিয়ে আন্তঃজেলা ব্লাইন্ড স্কুল টুর্নামেন্টের আয়োজন করেছে নদিয়া জেলা প্রশাসন। রবিবার নিজের চোখে কাপড় বেঁধে ব্যাট করে খেলার উদ্বোধন করেছেন জেলাশাসক সুমিত গুপ্ত। দৃষ্টিহীন পড়ুয়াদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতেই এই টুর্নামেন্টের আয়োজন। মুর্শিদাবাদের ঝুমকা প্রতিবন্ধী আলোক নিকেতনের ছাত্র ওসনাই শেখ। একশো শতাংশ দৃষ্টিহীন। শব্দই তার কাছে পৃথিবী চেনার অবলম্বন। বলটা বাউন্ডারির দিকে গড়াতেই উইকেট কিপার বলে উঠল, ‘‘ওসমান....!’’ মূহূর্তে নিখুঁত ডাইভ। এবং বাউন্ডারি লাইনের বেশ কিছুটা আগেই ওসমানের মুঠোয় সাদা বল। কী ভাবে সম্ভব হয় এমনটা? মালদহের মন্টু দাস, বর্ধমানের বিন্টু গড়াইরা বলছে, ‘‘অনুশীলন, অনুশীলন এবং অনুশীলন।’’ বেশিরভাগ পড়ুয়া উঠে এসেছে দরিদ্র পরিবার থেকে। মালদহের স্কুল শিক্ষক নারায়ণচন্দ্র মণ্ডল বলেন, ‘‘ছেলেগুলোর মনের জোর অসম্ভব। আমরা পথটা দেখিয়ে দিই। লড়াইটা ওরাই করে।”
বি ১ মানে একশো শতাংশ দৃষ্টিহীন, বি ২ মানে ৪০-৬০ শতাংশ দৃষ্টিহীন। আর বি ৩ মানে ২০-৪০ শতাংশ দৃষ্টিহীন। তিন ধরনের ছাত্রদের নিয়ে তৈরি হয় একটি দল। মাঠের ভিতরে কাউকে আলাদা করে বোঝার উপায় নেই। সকলে আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। তাদের পদক্ষেপ জানান দেয়—জিততেই হবে। আর সে মন্ত্র আঁকড়ে আঁধার মাঠে আলো জ্বালাচ্ছে ওরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy