ঘোড়ায় টানা গাড়িতে বিয়ে করতে যাওয়ার রীতি ফিরে আসছে।
বরযাত্রা চলেছে। মশাল-গ্যাসবাতির রোশনাইয়ে রাতের নবদ্বীপে যেন দিন নেমে এসেছে। বাজছে ঢাকঢোল, সানাই। ব্যান্ডের গানে তাল মিলিয়ে চলছে নাচ। ফাটছে বাজি। আলো ঝলমলে ভিড়ের একেবারে সামনে কোঁচা দুলিয়ে হাঁটছেন বরকর্তা। তিনি আবার যে সে লোক নন। শহরের সবথেকে ধনী ব্যবসায়ী তারাপদ বাগচি। পিছনে একটা সুসজ্জিত পালকির ভিতরে লাল মখমলের উপরে রুপোর থালায় চুড়ো করে সাজানো রুপোর মোহর।
বাগচিমশাই ওই মোহর নিয়ে যাচ্ছিলেন কনেপক্ষের এক হাজার লোককে উপহার দিয়ে চমক দেবেন বলে। কিন্তু বিয়ের আসরে পৌঁছে তিনিই চমকে গেলেন। সেখানে তাঁদের অভ্যর্থনা জানাতে অপেক্ষা করছেন এক হাজার বাইজি। আসলে, মোহর উপহারের কথা আগেই জেনে গিয়েছিলেন কনেপক্ষের লোকজন। বরপক্ষকে জবাব দিতে তাই বাইজি নিয়ে এসেছিল কনেপক্ষ। তখনকার বিয়ের পরতে পরতে ছিল বাবু কালচারের চালু রেওয়াজ। জাঁকজমককে সর্বোচ্চ স্তরে নিয়ে যেতে খরচের কার্পণ্য করতেন না তাঁরা। বাইজি নাচ থেকে বেলোয়ারি ঝাড়, হাতি-ঘোড়ার শোভাযাত্রা থেকে সাজানো জুড়ি গাড়ি, পালকি— বাদ যেত না কিছুই। নবাবি শহর লালবাগের ‘ছোটে নবাব’-এর স্মৃতিতে এখনও উজ্জ্বল সেই সময়ের শাদির জৌলুস। এ কালের বিয়ে দেখে তাঁর আক্ষেপ, ‘‘কোথায় সে সব হাতিঘোড়া, লোকলস্কর, বাদ্যি আতশবাজি, আতরের ফোয়ারা! এখনকার শাদির জৌলুস দেখলে মনে হয় ম্যাড়ম্যাড়ে মিছিল।”
তবে সম্প্রতি সেই নবাবিয়ানা না হলেও বিয়ের জৌলুস আবার ফিরছে সেই পুরনো সাজ-বাহনে ভর করেই। ফিটন থেকে পালকি, সাদা ঘোড়া থেকে ঝাড়বাতি সব মিলছে। মেজাজটাই আসল রাজা কি না! তবে হ্যাঁ, খরচ নিয়ে বেশি ভাবনাচিন্তা করলে চলবে না। বছর তিনেক আগে বিয়ে করেছেন বহরমপুর ইন্দ্রপ্রস্থের নিলয়কুমার চন্দ্র। পাত্রীও বহরমপুরের বাসিন্দা। পাত্রের মা নাছোড়বান্দা, ‘‘ছেলে বিয়ে করতে যাবে আমার শৈশবে দেখা ঘোড়ায় টানা সেই ফিটন গাড়িতে।’’ সে ইচ্ছেপূরণ হয়েছিল লালবাগের মনু শেখের সৌজন্যে। ফুল, আলো ও রঙিন কাগজে সাজানো সেই ঘোড়ায় টানা ফিটনেই বিয়ে করতে যান নিলয়কুমার। নিলয়কুমার হাসছেন, ‘‘সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা!” আর মনু বলছেন, “মানুষের রুচি, শখ পাল্টাচ্ছে। তাই ফিটনের চাহিদাও বাড়ছে। অনুষ্ঠানের ছ’সাত মাস আগে থেকেই গাড়ি ভাড়া হয়ে যায়।” চাহিদা দেখে মনুর মতো লালবাগের সাগর শেখ, সেনিবুর শেখেরাও নেমে পড়েছেন ব্যবসায়। তাঁরা বলেন, “কে জানত, পুরনো জিনিসের কদর বাড়বে!’’
নবদ্বীপের মৃত্যুঞ্জয় প্রামাণিকও বছর কয়েক আগে বাজারে নামান তাঁর নিজের নকশায় তৈরি ঘোড়ায় টানা ফিটন গাড়ি। সেই শুরু। কালনা থেকে কাটোয়া, করিমপুর থেকে কৃষ্ণনগরে বিয়ের অনুষ্ঠানে ছুটছে তাঁর ফিটন। মৃত্যুঞ্জয় জানান, এলাকায় ভাড়া নিলে হাজার আট থেকে দশ হাজার টাকা। বাইরে গেলে ১২-১৬ হাজার টাকা।
নিলয়কুমারের মতো সম্প্রতি কাশিমবাজারের শম্ভুলাল অগ্রবাল, হীরেন্দ্র চন্দ্রের মতো অনেকেই ফিটন কিংবা পালকি সাজিয়ে ছেলের বিয়ে দিয়েছেন। পিছনে হেঁটেছে বরযাত্রীর দল। আর দামি চার চাকাকেসঙ্গে যেতে হয়েছে দুলকি চালে চলা ঘোড়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy