সচেতনতার প্রচার। নিজস্ব চিত্র
নিজের প্রিয় জনের বিপদ তিনি আঁচ করতে পারেননি। উপসর্গ ছিল। কিন্তু সেগুলি যে ঘোর বিপদের ইঙ্গিতবাহী সে ব্যাপারে সচেতনতা ছিল না তাঁর বা তাঁর পরিবারের কারও। অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। বাঁচাতে পারেননি নিজের বাবা-কে। কিন্তু এই আঘাত থেকে চোয়াল শক্ত করে একটা প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। তাঁর পক্ষে যতরকম ভাবে সম্ভব মানুষকে সচেতন করতে থাকবেন। যাতে প্রাণঘাতী রোগের প্রাথমিক উপসর্গ চিনতে তাঁরা ভুল না-করেন। অন্তত রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করার সময়টুকু পান।
তিনি পূর্বস্থলীর নীলমণি ব্রহ্মচারী ইনস্টিটিউশনের ইংরাজির শিক্ষক সোমেশ মণ্ডল। তাঁর বাবা নিশাকর মণ্ডল একাত্তর বছর বয়সেও যথেষ্ট শক্তসমর্থ ছিলেন। নিজের হাতে জমিজমা সামলাতেন। বেশ কিছু দিন ধরে কাশি সারছিল না নিশাকরবাবুর। রাতের দিকে জ্বর-জ্বর ভাব। কাশতে-কাশতে ওঠা কফে সামান্য রক্তের ছিটে। পাত্তা দেননি নিশাকরবাবু। এ যে আসলে ক্যানসারের পূর্বলক্ষণ তা বুঝতে পারেননি বাড়ির লোক। যখন বোঝা গেল তখন ক্যানসার পৌঁছে গিয়েছে ‘স্টেজ ফোর’-এ। চিকিৎসক প্রেসক্রিপশনটা সোমেশবাবুর হাতে ফেরত দিয়ে জানিয়েছিলেন, বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছে।
তার পর মাস দু’য়েকও কাটেনি। ফুসফুসের ক্যানসারে মারা যান বর্ধমানের নিমার গ্রামের নিশাকর মণ্ডল। সেটা ছিল ২০০৯ সাল। সমস্ত সত্ত্বা অবশ হয়ে গিয়েছিল সোমেশবাবুর। নিজে শিক্ষিত মানুষ হয়ে কী করে বাবা-র রোগের উপসর্গ বুঝতে পারলেন না সেই ‘আফসোস’টা কুরেকুরে খেয়েছিল তাঁকে। তাঁর কাজের শুরুও তখনই। ঠিক করে ফেলেছিলেন, প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে ঘুরে সাধারণ মানুষকে ক্যানসার এবং তার প্রাথমিক উপসর্গ সম্পর্কে সচেতন করবেন। বললেন, ‘‘চিকিৎসার সামর্থ থাকতেও শুধু রোগ বুঝতে দেরির জন্য যদি কেউ তা করাতে না পারেন, শুধু অসহায়ের মতো চেয়ে মৃত্যুকে এগিয়ে আসতে দেখেন, তা হলে তার থেকে ভয়াবহ কিছু হয় না। তাই কাজটা শুরু করে দিলাম।’’ চার পাতার লিফলেট বিলি দিয়ে তাঁর কাজের সূচনা। বাবার মৃত্যুর কয়েক মাস পর থেকেই বাংলায় ছাপানো সেই লিফলেট নিয়ে ছুটির দিনে বেরিয়ে পড়তেন আশাপাশের গা-গঞ্জে। লিফলেট বিলি করে বুঝিয়ে বলতেন ক্যানসার রোগের কথা। তার উপসর্গের কথা। পরের বছর ২০১১ সালে নিজের হাতে তৈরি করলেন ক্যানসার সচেতনতা বিষয়ে একটি ন’ মিনিটের তথ্যচিত্র। নবদ্বীপ, পূর্বস্থলী, নাদনঘাট, মন্তেশ্বর, শ্রীরামপুর, বিদ্যানগরের মতো বিভিন্ন গ্রামে কোন অনুষ্ঠান হলেই উদ্যোক্তাদের কাছে চেয়ে নিতেন দশ মিনিট সময়। তার পর নিজের পয়সায় ভাড়া করা প্রজেক্টর দিয়ে দেখাতেন সেই তথ্যচিত্র। সেই কাজ এখনও একই ভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন।
গত রবিবার বিশ্ব ক্যানসার দিবসে নবদ্বীপ স্টেশন চত্বরে যাত্রীদের মধ্যে সকালে লিফলেট বিলি করেন শুরু সোমেশবাবু। পূর্বস্থলীর এক অনুষ্ঠানে বিলি করেন গাছের চারা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy