Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

প্রদীপ জ্বেলে জেগেছি সারারাত

আয়োজন সম্পূর্ণ করে করজোড়ে বাড়ির মহিলারা একসঙ্গে বলতেন, ‘আঁকিলাম পদ দু’টি, তাই মাগো নিই লুটি। দিবারাত পা দু’টি ধরি, বন্দনা করি। আঁকি মাগো আলপনা, এই পুজো এই বন্দনা’।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০১৭ ০১:৪৬
Share: Save:

নিকানো মেঝেতে পিটুলির আলপনা। জলচৌকির উপর বেতের চুপড়িতে উপচে পড়ছে ধান। তার উপরে দু’টি কাঠের লম্বা সিঁদুরকৌটো লালচেলি দিয়ে মুড়ে দেওয়া হয়েছে। সামনে থরে থরে সাজানো নাড়ু, মোয়ার মতো রকমারি ঘরে তৈরি মিষ্টি।

আয়োজন সম্পূর্ণ করে করজোড়ে বাড়ির মহিলারা একসঙ্গে বলতেন, ‘আঁকিলাম পদ দু’টি, তাই মাগো নিই লুটি। দিবারাত পা দু’টি ধরি, বন্দনা করি। আঁকি মাগো আলপনা, এই পুজো এই বন্দনা’। সব ছড়ার মধ্যেই থাকে বাসনা, অভিমান এবং আকাঙ্ক্ষা। পেঁচা, কড়ি, ধানের গোলা আঁকার সঙ্গে সঙ্গে তাই ছড়া কাটা হত। ‘আমি আঁকি পিটুলির গোলা, আমার হোক ধানের গোলা। আমি আঁকি পিটুলির বালা, আমার হোক সোনার বালা’। সেই সঙ্গে থাকে মন শুদ্ধের বার্তাও। ‘আঁকিলাম আলপনা, দূরে ফেলি আবর্জনা। শুভ শুদ্ধ মন নিয়ে, করি তব আরাধনা’। পূর্ববঙ্গে ‘আড়ি লক্ষ্মী’ নামে পরিচিত এই পুজোয় কোনও পুরোহিত বা মন্ত্রের প্রয়োজন পড়ত না। ছড়া কেটেই মা লক্ষ্মীকে আবাহন করত মেয়েরা। এ ভাবেই কোজাগরী লক্ষীপুজো আসত অবিভক্ত বাংলার গ্রামে। এলাকা ভেদে বদলাত উপকরণ, আয়োজন।

দেশভাগের পর ছিন্নমূল হয়ে নদিয়ার ও মুর্শিদাবাদের ছড়িয়ে পড়া ওপার বাংলার বাসিন্দারা আজও কোজাগরীর দিন তেমন করে মেতে ওঠেন লক্ষ্মীপুজোর আয়োজনে। “দুর্গাপুজো নিয়ে এত মাতামাতি ছিল না। বরং কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোই ছিল বড় উৎসব”— স্মৃতি হাতড়ে বলছিলেন আশি ছুঁইছুঁই বাসনা কংসবণিক। তিনি বলেন, “এখানকার কোজাগরীর সঙ্গে দেশের পুজোর মিল পাই না। আলপনা আর লক্ষ্মীর ছড়া বাদে আবার কোজাগরী হয় নাকি!”

নদিয়ার দোগাছি, জাহাঙ্গিরপুর, আনন্দনগর, শম্ভুনগরের মতো গ্রামে কোজাগরী পূর্ণিমা মানেই আলপনা। এই সব অঞ্চলেই দেশভাগের পর পূর্ববঙ্গের মানুষেরা এসে বসতি গড়েছেন। এক প্রবীণা বিন্দুবালা দেবী বলেন “পুরোহিত এসে সংস্কৃত মন্ত্রে ফুল বেলপাতা দিয়ে পুজো করবেন এমনটা ওদেশে কেউ ভাবতেও পারে না। বাড়ির এয়োদের ছড়াই ছিল লক্ষীপুজোর মন্ত্র।’’ বেলডাঙার বড়ুয়া কলোনির বাসিন্দা আলোরানি ভৌমিক বলেন, ‘‘ঢাকায় যখন বাড়ি ছিল কলাগাছ, মানকচু, ধান, কাঁচা সুপুরি, অশোক, অপরাজিতা, জয়ন্তী গাছকে লক্ষ্মী রূপে পুজো করেছি। প্রদীপ জ্বেলে জেগেছি সারা রাত।’’

বাংলাদেশের ঢাকার পূর্বাইলের জয়দেবপুরে ঘরে ঘরে পুজো হত। মেলা বসত। দেশভাগের পর যাঁরা এ দেশে ঠাঁই নেন তাঁরা পূর্ববঙ্গের স্মৃতি আঁকড়ে চাকদহের কাছে বল্লভপুরে মেলা শুরু করেন। এখন দরাপপুর, চৌগাছা এবং নেতাজি বাজার পর্যন্ত সেই মেলা ছড়িয়েছে। মণ্ডপে মণ্ডপে শুরু হয়েছে থিমের প্রতিযোগিতাও।

কান্দির মনোহরপুরে লক্ষ্মীপুজোই যেন শারদ উৎসব। বহুবছর আগে ওই গ্রামের বৈরাগীদের পরিবারিক পুজো ছিল লক্ষ্মীপুজো। পরে ওই পরিবার গ্রাম ছেড়ে গেলেও লক্ষ্মীপুজো বন্ধ হয়নি। পুরোন প্রথা মেনে মোড়লরাই পুজোর পরিচালনা করেন। লক্ষ্মীপুজো উপলক্ষে টানা তিনদিন ধরে নানা অনুষ্ঠান। বসবে যাত্রার আসরও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Lakshmi Puja Celebration
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE