Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

ওদের মন্ত্র একটাই, ‘চরৈবেতি’

বছর দু’য়েক আগে শিপ্রা কোটাল সেই লোধাপাড়া থেকে প্রথম মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিল। এ বছর সে উচ্চ মাধ্যমিক দেবে। শিপ্রাকে দেখেই তার উত্তরসূরীরা দাঁতে দাঁত চেপে পণ করেছিল, ‘‘দিদি পারলে আমরাও পারব।’’

চারে পাঠ: শিক্ষক শর্মিষ্ঠার সাহার (মাঝে) কাছে পড়ছে সুপ্রিয়া, শ্যামল, শুকু ও রাজু। নিজস্ব চিত্র

চারে পাঠ: শিক্ষক শর্মিষ্ঠার সাহার (মাঝে) কাছে পড়ছে সুপ্রিয়া, শ্যামল, শুকু ও রাজু। নিজস্ব চিত্র

সৌমিত্র সিকদার
চাকদহ শেষ আপডেট: ০৭ মার্চ ২০১৮ ০১:৪৭
Share: Save:

শিপ্রার দেখানো পথেই হাঁটছে লোধাপাড়া।

চাকদহের ২০ নম্বর ওয়ার্ডে নাথপুকুর এলাকায় ৬৩ ঘর লোধা সম্প্রদায়ের লোকজনের বাস। ওই এলাকাটা লোধাপাড়া নামেই পরিচিত।

বছর দু’য়েক আগে শিপ্রা কোটাল সেই লোধাপাড়া থেকে প্রথম মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিল। এ বছর সে উচ্চ মাধ্যমিক দেবে। শিপ্রাকে দেখেই তার উত্তরসূরীরা দাঁতে দাঁত চেপে পণ করেছিল, ‘‘দিদি পারলে আমরাও পারব।’’

এ বছর সেই লোধাপাড়া থেকেই মাধ্যমিক দিচ্ছে শিপ্রার বোন সুপ্রিয়া কোটাল, শ্যামল কোটাল, শুকু মল্লিক ও রাজু মান্ডি। তারা বলছে, ‘‘দিদির শেখানো একটা মন্ত্রই আমরা জপ করি—চরৈবেতি।’’

২০০৬ সালে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স্ক শিক্ষা ও লোকহিত বিভাগ এই এলাকার শিক্ষার প্রসারের কাজে হাত লাগিয়েছিল। গত কয়েক বছর থেকে তার সুফলও মিলতে শুরু করেছে। প্রকল্পের সঞ্চালক নিলাদ্রীশেখর বিশ্বাস বলছেন, ‘‘আমার চেয়েছিলাম, পিছিয়ে পড়া আদিবাসী এলাকায় শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে। সে কথা এলাকার মানুষকে বুঝিয়ে বলেছিলাম। তাঁদের অনেকে সাড়াও দিয়েছিলেন। এখন আরও অনেকেই এগিয়ে আসছেন।’’

নিলাদ্রী জানান, ওই এলাকার বহু ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার দায়িত্ব নিয়েছেন তাঁরা। তাদের সাফল্য দেখে এখন অনেকেই তাঁদের ছেলেমেয়েদেরও পড়তে পাঠাচ্ছেন। পাশাপাশি পুরসভা ওই পড়ুয়াদের পড়ার জন্য ঘরও তৈরি করে দিয়েছে। এই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত মলয় ভট্টাচার্য বলছেন, ‘‘লোধাপাড়ায় ৬৩ টি পরিবারে ২৪১ জন সদস্য রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ৫১ জন এখন লেখাপড়া করছে। ওদের পড়ানোর জন্য ৬ জন শিক্ষকও রয়েছেন।” শর্মিষ্ঠা সাহা তাঁদের অন্যতম। শর্মিষ্ঠা বলছেন, ‘‘এখানকার ছেলেমেয়েদের মনের জোর কুর্নিশ করার মতো। ওরা যে ভাবে নিষ্ঠার সঙ্গে লেখাপড়া করে, এক দিন ওরা সফল হবেই।’’

লোধাপাড়া থেকে এ বছর যে চার জন মাধ্যমিক দিচ্ছে তারা সকলেই চাকদহের ভবানীপুর সুকান্ত বিদ্যাপীঠের পড়ুয়া। স্কুলের শিক্ষকেরা জানাচ্ছেন, পিছিয়ে পড়া ওই এলাকার বহু ছেলেমেয়ে তাঁদের স্কুলে পড়ে। তাদের সবরকম ভাবে সাহায্যও করা হয়। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, বেশ কয়েক বছর আগে মেদিনীপুর থেকে এই এলাকায় মাটি কাটার কাজে এসেছিল কয়েকটি লোধা পরিবার। তার পর থেকে তাঁরা এখানেই থেকে গিয়েছেন। লোধা পরিবারের বেশিরভাগ সদস্য জঙ্গল থেকে গাছের শিকড় সংগ্রহ করে বিক্রি করেন। নুন আনতে পান্তা ফুরনো সংসারে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখানোটা তাঁরা বিলাসিতা বলেই মনে করতেন।

এখন অবশ্য লোধা পরিবারের লোকজন বলছেন, ‘‘যা করার ওই স্যরেরাই করেছেন। এখন বুঝেছি, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া না শেখালে তাঁরাও কোনও দিন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। আমরা চাই না, ছেলেমেয়েরা আমাদের মতোই কষ্ট করে বেঁচে থাকুক।’’ এ বছরের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী সুপ্রিয়া, শ্যামল, শুকু ও রাজুরা বলছে, ‘‘এই পরীক্ষা আমাদের কাছে যুদ্ধের মতোই। আর সে যুদ্ধ জিততেই হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Madhyamik Lodhapara Education
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE