Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

অশান্তির আশঙ্কা নিয়েই আজ ভোট

আশঙ্কাটা ছিলই। মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাসের পরে নদিয়া ও মুর্শিদাবাদ, পড়শি এই দুই জেলায় সেই আশঙ্কাটা যেন আরও বেড়ে গিয়েছে। শুক্রবার দুপুরে রানাঘাটের স্টেশন লাগোয়া চায়ের দোকানে কথা হচ্ছিল এক প্রৌঢ়ের সঙ্গে। চারদিকে চোখ বুলিয়ে কানের কাছে মুখ এনে তিনি বলছিলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী কী বলেছে, শুনেছেন একবার?’’ উত্তরের অপেক্ষা না করেই তিনি বলে চলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী নিজেই যদি বলেন যে, কলকাতার ভোট হয়েছে শান্তিপূর্ণ ভাবে, কালকের ভোটও সে ভাবেই হবে, তাহলে তো আর বলার কিছু নেই!’’

তখনও আতঙ্ক কাটেনি। মুর্শিদাবাদের ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে গৌতম প্রামাণিকের তোলা ছবি।

তখনও আতঙ্ক কাটেনি। মুর্শিদাবাদের ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে গৌতম প্রামাণিকের তোলা ছবি।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০১৫ ০১:১৬
Share: Save:

আশঙ্কাটা ছিলই। মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাসের পরে নদিয়া ও মুর্শিদাবাদ, পড়শি এই দুই জেলায় সেই আশঙ্কাটা যেন আরও বেড়ে গিয়েছে।

শুক্রবার দুপুরে রানাঘাটের স্টেশন লাগোয়া চায়ের দোকানে কথা হচ্ছিল এক প্রৌঢ়ের সঙ্গে। চারদিকে চোখ বুলিয়ে কানের কাছে মুখ এনে তিনি বলছিলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী কী বলেছে, শুনেছেন একবার?’’ উত্তরের অপেক্ষা না করেই তিনি বলে চলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী নিজেই যদি বলেন যে, কলকাতার ভোট হয়েছে শান্তিপূর্ণ ভাবে, কালকের ভোটও সে ভাবেই হবে, তাহলে তো আর বলার কিছু নেই!’’

বৃহস্পতিবার বিকেলে প্রচার শেষ হয়ে গিয়েছে। তারপর থেকে মিছিল, স্লোগান কিংবা মাইকের আওয়াজ থেমে গিয়েছে। হঠাৎ করেই যেন কেমন শান্ত হয়ে গিয়েছে রানাঘাট, গয়েশপুর, শান্তিপুর, হরিণঘাটা, কল্যাণীর মতো এলাকা। সেই সব এলাকায় ঘুরতে ঘুরতে মনে হচ্ছিল, ঝড়ের আগের প্রস্তুতি নয় তো? খাঁ খাঁ দুপুরের নিস্তব্ধতা খানখান করে মাঝেমধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে গোটা কয়েক মোটরবাইক। কোথাও চায়ের দোকানের সামনে, কোথাও কোনও ক্লাবের সামনে থেকে চারপাশে তীক্ষ্ণ নজর রাখছে বেশ কয়েকজন যুবক। মাঝেমধ্যে মোবাইলে ফোন এলেই সিঙ্গল স্ট্রোকে বাইক স্টার্ট দিয়ে সাঁ করে বেরিয়ে যাচ্ছে কোনও দিকে।

হরিণঘাটায় ঢুকে আর এক ধাঁধায় পড়তে হল। এলাকার পরিবেশ দেখে কে বলবে রাত পোহালেই ভোট! ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের উপর দিয়ে বড় জাগুলিয়া মোড় থেকে বাঁ দিকে ঘুরেই হরিণঘাটা বাজার। বাজারের মধ্যেই ছোট ছোট করে তৈরি করা হয়েছে তৃণমূলের নির্বাচনী শিবির। সেখানে তৃণমূল সমর্থকদের সঙ্গে জটলা করছেন এমন অনেকেই যাদের এলাকার লোকই চেনেন না। ওরা কারা? প্রশ্নটা করতেই চকিতে সতর্ক হয়ে গেলেন স্থানীয় এক ব্যবসায়ী। কোনও উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, ‘‘কোন মিডিয়া? ভাল কিছু আপনাদের চোখে পড়ে না? আরে দাদা, ইলেকশনের সময় চারটি বাইরের লোকজন আসবে না? পাড়ার পুজোতেও তো বাইরের লোকজন আসে। কই, তখন তো কোনও সমস্যা হয় না।’’

বাজার ছাড়িয়ে গাঙ্গুরিয়ার দিকে যেতেই পথ আটকাল জনা কয়েক যুবক। ওই যুবকদের আসতে দেখেই ভিতরে চলে গেলেন বাড়ির সামনে ভিড় করা মহিলারা। সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার পরে ওই যুবকরা বলছিলেন, ‘‘ভোটের আগের চেহারা দেখতে এসেছেন? দেখুন না। কোথাও কোনও গোলমাল পাবেন না। ভোট হবে শান্তিতেই। মিলিয়ে নেবেন।’’ সেই শান্তির নমুনা কী হবে সে উত্তর অবশ্য সময় বলবে। কিন্তু নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এলাকার জনাকয়েক বাসিন্দারা বলছিলেন, ‘‘শ্মশানেও তো শান্তি থাকে। এরা কোন শান্তির কথা বলছে তা ওরাই ভাল বলতে পারবে।’’

হরিণঘাটা পুরসভায় এই প্রথমবার ভোট হচ্ছে। প্রথম ভোটের উচ্ছ্বাস অনেকটাই ঢাকা পড়ে গিয়েছে আশঙ্কায়। স্থানীয় এক বধূ বলছেন, ‘‘সকাল সকাল ভোট দিয়ে বাড়ি ফিরতে পারলেই বাঁচি। চারপাশে যা সব দেখছি, শুনছি তাতে ভয় আরও বেড়েই যাচ্ছে।’’

বৃহস্পতিবার রাত থেকেই অশান্তি শুরু হয়ে গিয়েছে শান্তিপুর ও লালবাগে। সেখানেও ভোটের আগের দিন থেকেই রীতিমতো আতঙ্কে আছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। বিরোধীদের বহিরাগত অভিযোগটা যে নেহাত কথার কথা নয়, তার প্রমাণও মিলেছে। দুই জেলার বেশ কিছু এলাকাতেই বৃহস্পতিবার রাত থেকেই দেখা মিলেছে এমন অনেক মুখের যাঁদের কস্মিনকালেও সেই এলাকাতে দেখা যায়নি। এলাকার লোকজনও তাদের চেনেন না। বৃহস্পতিবার গভীর রাতে মুর্শিদাবাদ পুরসভার শেষ সীমানা ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের পুঠিয়া পাড়ায় তৃণমূলের দুষ্কৃতী দল দাপিয়ে বেড়িয়েছে বলে অভিযোগ। শুক্রবার সকালেও স্থানীয় বাসিন্দাদের চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। গোটা বিষয়টি জানিয়ে শুক্রবার ওই ওয়ার্ডের কংগ্রেস প্রার্থী তথা বিদায়ী কাউন্সিলর চম্পা দাস মুর্শিদাবাদ থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন। কিন্তু পুলিশ সব জেনেও কোনও পদক্ষেপ করেনি বলেই অভিযোগ। বিষয়টি জানানো হয়েছে মহকুমাশাসক প্রবীর চট্টোপাধ্যায়কেও। তিনি নির্বিঘ্নে ও শান্তিতে মানুষ যাতে ভোট দিতে পারেন, তার জন্য পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করে সব রকম পদক্ষেপ করার আশ্বাস দেন। কিন্তু সে আশ্বাসেও বিশেষ ভরসা পাচ্ছে না পুঠিয়াপাড়া। বহরমপুর-জিয়াগঞ্জ রাজ্য সড়কের জিয়াগঞ্জের দিকে যেতে পিচ রাস্তা থেকে বাঁ দিকে পুঠিয়াপাড়া। পদ্মার ভাঙনে সব খুইয়ে বিভিন্ন এলাকা থেকে উঠে এসে ওই এলাকায় নতুন বসতি গড়েছেন প্রায় শ-খানেক পরিবার। নামকরণ হয়েছে নতুন পাড়া। সেখানকার অনেকেরই এখনও ভোটের তালিকায় নাম ওঠেনি। কিন্তু এত হিসেব করে আর কে কবে আতঙ্ক ছড়িয়েছে? চম্পাদেবীর অভিযোগ, তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা তো নেতাদের নির্দেশে কাজ করছে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুমকি দেওয়ার পাশাপাশি ঘরবাড়ি ভাঙচুর করে ভোটের আগে সন্ত্রাসের পরিবেশ কায়েম করেছে। যাতে মানুষ ভয়ে ভোট দিতে না যান। এ সব অভিযোগ অস্বীকার করে তৃণমূলের জেলা সভাপতি মান্নান হোসেন বলেছেন, ‘‘নিজেদের অবস্থা খারাপ বুঝতে পেরে কংগ্রেস এ সব মিথ্যে অভিযোগ করছে।’’

বৃহস্পতিবার রাতে গোলমাল হয়েছে শান্তিপুরেও। শান্তিপুর ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূল কর্মীদের বাড়িতে হামলা চালানোর অভিযোগ উঠল দলেরই বিধায়ী পুরপ্রধান অজয় দে-র অনুগামীদের বিরুদ্ধে। অন্য দিকে, ১১ নম্বর ওয়ার্ডে সিপিএম কর্মীদের বাড়িতে হামলা চালানোর অভিযোগ উঠল তৃণমূলের বিরুদ্ধে। শুক্রবার সকালে থানার সামনে দাঁড়িয়ে অজয়বাবুর বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিচ্ছিলেন তৃণমূলের এক মহিলা। অজয়বাবুকে গ্রেফতারের দাবিতে রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন তৃণমূলেরই লোকজন। পরে পুলিশ এসে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়ে অবরোধ তুলে দেয়। কিন্তু তাতেও যেন রাগ কমছিল না অবরোধকারীদের।

তাঁদেরই একজন বলছিলেন, ‘‘আমরা তৃণমূল করি। তৃণমূলের প্রার্থীর হয়ে নির্বাচনে খাটছি। আর এটাই নাকি আমাদের অপরাধ। সেই কারণেই তৃণমূলেরই বিধায়ক কি না রাতের অন্ধকারে লোক পাঠিয়ে হামলা করাচ্ছে আমাদের উপরে!’’ স্থানীয় মহিলারা সমস্বরে বলছিলেন, ‘‘পুলিশের উপরে আমাদের কোনও ভরসা নেই। এই থানার ওসি নিজেই অজয়বাবুর নির্বাচনী এজেন্টের মতো কাজ করছেন। তাই রাস্তা অবরোধ করা ছাড়া আমাদের উপায় ছিল না।’’

মহিলাদের ওই ভিড়ের পাশে চোখ মুখে একরাশ আতঙ্ক নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন শান্তিপুরের ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল প্রার্থী সুব্রত ঘোষের অনুগত গোবিন্দ দাস। বৃহস্পতিবার রাতের ঘটনার পরে তাঁর আতঙ্ক তখনও কাটেনি। তিনি বলছিলেন, ‘‘রাত তখন প্রায় সোয়া একটা হবে। বাড়ির দরজায় লাথির শব্দ। দরজার ওপাশ থেকে একজন বলে, থানা থেকে আসছি। দরজা খুলতেই ওরা মাথায় আগ্নেয়াস্ত্র ধরে বলে বুথের ধারে কাছে ঘেঁষলে জানে মেরে দেবে।’’ প্রচণ্ড মারধর করা হয়েছে অসিত পালকেও। তিনি শান্তিপুর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। কেন এমন ঘটল? তৃণমূল প্রার্থী সুব্রতবাবু বলেন, ‘‘ওরা সকলেই অজয় দে-র লোক। আমার ভোটে দাঁড়ানো মেনে নিতে পারেননি অজয়বাবু। সেই কারণে তাঁর এক ঘনিষ্ঠকে নির্দলে দাঁড় করানো হয়। সেই নির্দল প্রার্থীকে জেতাতেই অজয়বাবু এ সব কাণ্ড করেছেন।’’ অজয়বাবু বলেন, ‘‘এ সবই নাটক। বানানো গল্প।’’

পুরভোটের দিন আশঙ্কায় রয়েছে ধুলিয়ান ও জঙ্গিপুরও। জেলায় এ পর্যন্ত পুরভোট নিয়ে সবচেয়ে বেশি অশান্তির ঘটনা ঘটেছে ধুলিয়ান ও জঙ্গিপুরেই। দুই শহরেই বিরোধীদের পক্ষ থেকে অভিযোগ উঠেছে, বিভিন্ন লজ, হোটেলে শাসক দল গ্রাম থেকে বহিরাগতদের নিয়ে এসে রেখেছে। ফলে ভোটের দিন অশান্তির আশঙ্কা রয়েছে দুটি শহরেই। বৃহস্পতিবার রাতে জঙ্গিপুরের ৮ ও ১১ নম্বর ওয়ার্ডে সিপিএম সমর্থকদের বাড়ি ঢুকে পুলিশ ভাঙচুর চালিয়েছে। সিপিএমের অভিযোগ, পুলিশ তাদের হুমকি দিয়েছে, তৃণমূলকে ভোট না দিলে পরিণাম ভাল হবে না। পুলিশ অবশ্য সে অভিযোগ মানতে চায়নি।

নদিয়া-মুর্শিদাবাদের ১৪টি পুর এলাকার ৩৮৩টি বুথে আজ, শনিবার পুরভোট। রাজ্যে পালাবদলের পরে প্রথম এই পুরভোট কতটা শান্তিপূর্ণ হবে, তা নিয়ে প্রশ্নটা কিন্তু থেকেই গেল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE