কলকাতার বো-ব্যারাক নয়। সেখান থেকে অনেকটা দূরে বেগোপাড়া, অ্যান্টনিপাড়া, যোসেফপাড়া, মরিয়মপাড়া, খ্রিস্টানপাড়া। নদিয়ার রানাঘাটের কাছে বেদ্যপুর ২ গ্রাম পঞ্চায়েতে কলকাতার আড়ম্বর নেই। তবে বড়দিনের আয়োজনে কোনও খামতি নেই। সকলেই নিজের নিজের মতো করে আয়োজন করেছেন সেই কবে থেকে। আর ২৫ ডিসেম্বর সেই দিনটায় খুশির তুফান।
যদিও যিশু খ্রিস্টের জন্মদিনটি আদতে আর কোনও ধর্ম সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। তবু এই এলাকার বাসিন্দারা প্রায় সকলেই খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী। তাই তাঁদের বাড়িতে বিশেষ প্রার্থনা, সাজগোজ আর খাওয়া দাওয়া চলছে। দিন পনেরো ধরে চলছে সাজগোজের পালা। যাঁর বাড়িতে যতটুকু জায়গা রয়েছে, সেখানেই সাজানো হয়েছে পুতুল। মাটির পুতুল, বিচালি, রঙিন কাগজ দিয়ে তৈরি হয়েছে যিশুর জন্ম বৃত্তান্ত। আবার পাড়ায় পাড়ায় নানা অনুষ্ঠান হয়েছে বড়দিনের পূর্ব সন্ধ্যা থেকেই। প্যান্ডেল, আলো, মাইকের শব্দে গমগম করেছে এলাকা। বাড়ি ফিরেছেন দূরে থাকা আত্মীয় স্বজনরা। কারও ছেলে ফিরেছেন, কারও স্বামী।
কৃষ্ণনগরেও খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী মানুষের বাস বহু পুরোনো। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষই রুজির টানে দেশের বাইরে থাকেন। কেউ অস্ট্রেলিয়া, কেউ কুয়েতে। কেউ দুবাই বা সৌদি আরবে। কিন্তু বড়দিনটা যাতে বাড়ির পরিবারের সঙ্গে কাটাতে পারেন, তার জন্য হাজার হাজার মাইল উজিয়ে বাড়ি ফেরেন তাঁরা। উৎসবের দিনে প্রিয়জনকে পাশে পেয়ে বদলে যায় বাড়ির আবহাওয়াও।
কর্মসূত্রে দুবাই থাকেন আরশিপাড়ার বাসিন্দা অভিজিৎ লুইস সরকার। বড়দিন উপলক্ষে দিন পনেরো আগে বাড়ি ফিরেছেন তিনি। দুই ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে বাজারে ঘুরে কেক তৈরির উপকরণ থেকে শুরু করে বাড়ি সাজানোর আলো কিনে নিয়ে এসেছেন। নিজের হাতে তৈরি করেছেন কেক। আলো দিয়ে সাজিয়েছেন গোটা বাড়ি। কিন্তু তাতেই কী মন ভরে? অন্য বারের মতো এবারও তিনি রান্নাঘরের দখল নিয়েছেন। রান্না করেছেন দুবাই থেকে শিখে আসা বিশেষ ধরনের মাংস। অভিজিৎবাবুর স্ত্রী পলিনাদেবী বলেন, “ওঁর ফেরার অপেক্ষায় আমরা সারাটা বছর মুখিয়ে থাকি। ছেলেরাও অপেক্ষায় থাকে। ছেলেরা বাবাকে ছাড়া বড়দিনের কথা ভাবতেই পারে না।’’
তবে অনেকেই ফিরতে পারেননি। গাংনাপুরের বাসিন্দা শরদিন্দু মণ্ডল কর্মসূত্রে থাকেন সৌদি আরবে। ছুটি না পাওয়ায় এ বছর বড়দিনে ফিরতে পারেননি পরিবারের কাছে। বাড়িতে তাই সব আয়োজন কেমন যেন খাপছাড়া। তাঁর স্ত্রী শিপ্রা মণ্ডল বলেন, “এ সময় বাড়িতে আত্মীয়স্বজনরা আসেন, তাঁদের আপ্যায়ন আছে। স্বামী ফিরতে পারেননি আর কী করা যাবে, ছেলেমেয়েদের নিয়েই আনন্দ করছি।” বাড়ি ফিরতে পারেননি অর্পণ গোমসও। কাজের সুবাদে তিনি দুবাইতে। বছর ছয়েকের মেয়ে বারবার বলছে বাবার কথা। ফিরতে পারেননি কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা দুবাইতে কর্মরত রাজেশ অ্যান্টনি মাস্টারও।
গত আট বছর ধরে কুয়েতে রয়েছেন মিল্টন বিশ্বাস। প্রতিবার যে উৎসবের দিনে বাড়ি ফিরতে পারেন তা নয়। তিন বছর পরে এ বার দিন পাঁচেক আগে বড় দিনে বাড়ি ফিরেছেন তিনি। তাই এবার যেন গোটা পরিবারটাই ঝলমলিয়ে উঠছে উৎসবের আনন্দে। তারপর থেকে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সঙ্গে বন্ধুদের সঙ্গে মিলে সারা দিন শুধু হই হই। মিল্টনবাবু বলেন, “জানি না আবার কবে বড়দিনে বাড়ি ফেরার সুযোগ পাব। তাই এবার কোনও চাই না। চুটিয়ে আনন্দ করছি।” সকলেই যেন সেটাই চাইছেন। তাই এদিন সকাল থেকেই শহরের রাস্তায়, গির্জার সামনে ভিড় জমতে শুরু করেছে। বেলা যত বেড়েছে ততই যেন পাল্লা দিয়ে বেড়েছে সেই ভিড়।
অনেক বাড়িতেই রান্না হয়েছে নানা সুস্বাদু পদ। হরেক কিসিমের কেক, পুডিং, নিমকি, পিঠে, পায়েস, সেই সঙ্গে মাংস, বিরিয়ানি, ফ্রায়েড রাইস— আরও কত কী! টুম্পা গোমস বলেন, “শুধু খাওয়া দাওয়া নয়, এই দিনটার জন্য সারা বছর অপেক্ষা করে থাকি। তাই কবে থেকে চলছে প্রস্তুতি।”বড়দিনের উৎসব উপলক্ষে শুরু হয়েছে মেলা। রানাঘাটে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের দু’ধারে বসেছে অস্থায়ী দোকান। কেক বিস্কুট, প্যাটিস, কুকিজ থেকে বেলুন, পুতুল— শিশুদের মনোরঞ্জনের হরেক উপকরণ। সকাল চোখে পড়েছে থেকেই চার্চে ঢোকার দীর্ঘ লাইন। তবে সেখানে মোটেই একটি ধর্মের মানুষরা নন, ছিলেন সব সম্প্রদায়ের মানুষ। এ যেন এক মিলন উৎসব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy