Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

ধাক্কায় ছিটকে লরির মুখে পড়ল লছিমনটা

জঙ্গিপুর আদালতে মামলা ছিল। তাই নিজেদেরই এক জনের লছিমনে চেপে চলেছিলেন গ্রামের ন’জন। তাদের এক জন ছ’বছরের বালক। বাবা-মা-ঠাকুমার সঙ্গে শহর দেখতে যাবে বলে সে বায়না ধরেছিল। আর ফেরা হল না। খারাপ রাস্তায় লাফাতে লাফাতে চলা লছিমনকে পাশ কাটাতে গিয়ে ধাক্কা দিল পিছন থেকে আসা ছোট লরি।

কান্নায় ভেঙে পড়েছেন সর্বেশ্বর মণ্ডলের পরিবার। সামশেরগঞ্জের উত্তর অন্তর্দীপা গ্রামে অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়ের তোলা ছবি।

কান্নায় ভেঙে পড়েছেন সর্বেশ্বর মণ্ডলের পরিবার। সামশেরগঞ্জের উত্তর অন্তর্দীপা গ্রামে অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়ের তোলা ছবি।

বিমান হাজরা
আহিরন শেষ আপডেট: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০১:৫৪
Share: Save:

জঙ্গিপুর আদালতে মামলা ছিল। তাই নিজেদেরই এক জনের লছিমনে চেপে চলেছিলেন গ্রামের ন’জন।

তাদের এক জন ছ’বছরের বালক। বাবা-মা-ঠাকুমার সঙ্গে শহর দেখতে যাবে বলে সে বায়না ধরেছিল। আর ফেরা হল না।

খারাপ রাস্তায় লাফাতে লাফাতে চলা লছিমনকে পাশ কাটাতে গিয়ে ধাক্কা দিল পিছন থেকে আসা ছোট লরি। তাতে বেসামাল হয়ে উল্টো দিক থেকে আসা বালি বোঝাই লরির সামনে চলে যায় লছিমন। এক ধাক্কায় লছিমন তো বটেই, পিছনের ছোট লরিও পাশের কুড়ি ফুট খাদে। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পিছনে ঝুলছে বালির লরিও।

ছোট লরির পিছনে আসা এক মোটরবাইক আরোহী এ দিক-ও দিক ফোন করেছিলেন। ছুটে এসেছিলেন স্থানীয় লোকজন। কিন্তু ঘটনাস্থলেই মারা যান সাত জন। যাঁরা সকলেই সামশেরগঞ্জ থানার উত্তর অন্তর্দীপা গ্রামের এক পাড়ার তিনটি পরিবারের বাসিন্দা। পুলিশ জানায়, ভ্যানের চালক সর্বেশ্বর মণ্ডল (৩১), তাঁর মা শান্তিলতা (৫৬), স্ত্রী মেনকা (২৮) ও ছোট ছেলে সুদীপ (৬) ছাড়াও মারা গিয়েছেন শ্যামচাঁদ সরকার (২৬), বাসুদেব মণ্ডল (৫১) ও তাঁর ছেলে স্বরূপ (২৬)।

বুধবার সকাল ১০টা নাগাদ আহিরন সেতুর কাছে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কে এই দুর্ঘটনায় বেঁচে যান কেবল দু’জন। তাঁদের মধ্যে নিমাই মণ্ডলর নামে এক জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তুলসী সরকার নামে ৬৫ বছরের এক বৃদ্ধ মোটামুটি অক্ষত থাকলেও মানসিক ভাবে এতটাই ভেঙে পড়েছেন যে শ্বাসকষ্ট শুরু হওয়ায় জঙ্গিপুর মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়েছে তাঁকে।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, জঙ্গিপুর আদালতে একটি ফৌজদারি মামলায় হাজিরা দিতে সর্বেশ্বরের লছিমনে চেপে রওনা দিয়েছিলেন তিন পরিবারের লোকজন। ২০০৯ থেকে সেই মামলা চলছে গ্রামেরই এক বাসিন্দার সঙ্গে তাঁদের মামলা চলছে। বায়না ধরায় সর্বেশ্বর ছোট ছেলেকেও সঙ্গে নেন।

৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক ঝাঁ চকচকে হলেও দুর্ঘটনাস্থলের আগে-পরে দুই কিলোমিটার মতো বেশ খারাপ। নতুন সেতু তৈরি শেষ না হওয়ায় ওই রাস্তা ঠিক করার কাজ শুরু হয়নি এখনও। ওই রাস্তা ধরেই বোনকে নিয়ে মোটরবাইকে জঙ্গিপুরে যাচ্ছিলেন সামশেরগঞ্জের নামো চাচণ্ডের যুবক সুদীপ দাস। তিনি জানান, রাস্তায় তেমন গাড়িঘোড়াও ছিল না। আহিরনের ভগবতী দাসী সেতু পার হয়ে বাঁক ঘুরে বড় জোর ৭০০ মিটার মতো এগিয়েছে লছিমন। পিছনে ছিল একটি ছোট লরি। তারও ৫০ মিটার মতো পিছনে তাঁরা।

সুদীপের কথায়, ‘‘ছোট লরিটি লছিমনকে পাশ কাটিয়ে বেরনোর চেষ্টা করছিল। লছিমনটিও চলছিল যথেষ্ট গতিতে। রাস্তাও এত খারাপ যে সব গাড়িই লাফাচ্ছিল। হঠাৎ ছোট লরিটি ধাক্কা মারল লছিমনকে। ওই সময়েই উল্টো দিক থেকে আসছিল বালি বোঝাই লরি। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে লছিমনটি সেটির সামনে গিয়ে পড়ে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই লছিমন এবং ছোট লরি গিয়ে পড়ে বাঁ দিকে প্রায় বিশ ফুট নীচে খাদে। রাস্তার শেষ প্রান্তে খালের উপরে ঝুলতে থাকে বালি বোঝাই লরিটি।”

সুদীপ নিজের এক আত্মীয়কে ফোন করে খবর দেন। লোকজন জড়ো করার জন্য চিৎকারও করতে থাকেন। আশপাশের লোকজন এসে উদ্ধারে হাত লাগান। মিনিট কুড়ি বাদে পুলিশও চলে আসে। তারা হতাহতদের হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। এর পরে রাস্তার দশা নিয়ে পুলিশের সামনেই বিক্ষোভ শুরু হয়। বিক্ষোভের মুখে পড়েন সুতির বিধায়ক ইমানি বিশ্বাসও।

দুর্ঘটনার পরে। সুতির আহিরনে তোলা নিজস্ব চিত্র।

সামশেরগঞ্জের ধুলিয়ান-পাকুড় রাজ্য সড়কের ঝাড়খণ্ড লাগোয়া গ্রাম অন্তর্দীপা। দুপুর গড়িয়েও উনুন ধরেনি মণ্ডলপাড়ার কোনও বাড়িতে। বিধবা মা, স্ত্রী, চার ছেলেমেয়ে, এক সন্তান নিয়ে ফিরে আসা বিধবা বোনের সংসারে সর্বেশ্বরই ছিল একমাত্র রোজগেরে। বাড়়িতে বড় বলতে রয়ে গেলেন সেই বিধবা বোন অম্বিকা। আর আছে সর্বেশ্বরের দুই মেয়ে, ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী পুষ্প ও পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া রিঙ্কি আর দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়া ছেলে সুমন্ত। ভাই যাচ্ছে শুনে সুমন্তও যাওয়ার জেদ ধরেছিল। শহর থেকে চকোলেট এনে দেবেন বলে তাকে নিরস্ত করেন ঠাকুমা শান্তিলতা। কাঁদতে-কাঁদতে অম্বিকা বলেন, “এ ভাবে গোটা পরিবার চলে যাবে, কী করে জানব? এই বাচ্চাগুলোকে নিয়ে কী করে বাঁচব, তা-ও জানি না।

কয়েকটা বাড়ি পরেই বাসুদেব মণ্ডলের পরিবারও। সেই বাড়িতেও কান্নার রোল। শ্যামচাঁদ ছিলেন গ্রামের মোড়ল। বেশির ভাগ বাড়ির লোকই তাঁর কাছে যেতেন পরামর্শ নিতে। তাঁর মৃত্যু যেন গোটা গ্রামের অভিভাবককে কেড়ে নিয়েছে। গোটা গ্রামের কেউ এই এক সঙ্গে এতগুলো মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না। ক্ষোভে ফুঁসছে গোটা গ্রাম।

পুলিশও মেনে নেয়, খারাপ পথে বেপরোয়া যান চলাচলের কারণে দুর্ঘটনা প্রায় নিত্যদিনের রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত ছ’মাসে ৯টি দুর্ঘটনায় প্রাণ গিয়েছে অন্তত চার জনের। বছর দুই আগে ধান বোঝাই ছোট লরি উল্টেও মৃত্যু হয়েছিল ছ’জনের। কিন্তু তার পরেও রাস্তা সারানোর ব্যবস্থা হয়নি। জাতীয় সড়কে বেআইনি ভাবে লছিমন চলাচলও বন্ধ করা হচ্ছে না। অদূর ভবিষ্যতেও যে হবে, এমন আশ্বাস এ দিন অন্তত মেলেনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE