Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

নিজেদের ব্যাঙ্ক পেয়ে খুশি চুমকিরা

খাদি গ্রামোদ্যোগের জন্য সুতো কাটার কাজ করেন চুমকি দেবনাথ। কিন্তু মজুরি আনতে গেলেই হত সমস্যা। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নেই চুমকির, কিন্তু নগদ টাকা হাতে দেওয়ার নিয়ম নেই সরকারি সংস্থার। প্রতিবারই নানা কথা শুনতে হত। কিন্তু আর নয়।

গ্রাহকদের সঙ্গে লেনদেন করছেন এক ব্যাঙ্ককর্মী। —নিজস্ব চিত্র।

গ্রাহকদের সঙ্গে লেনদেন করছেন এক ব্যাঙ্ককর্মী। —নিজস্ব চিত্র।

শুভাশিস সৈয়দ
রানিনগর  শেষ আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০১৫ ০১:২১
Share: Save:

খাদি গ্রামোদ্যোগের জন্য সুতো কাটার কাজ করেন চুমকি দেবনাথ। কিন্তু মজুরি আনতে গেলেই হত সমস্যা। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নেই চুমকির, কিন্তু নগদ টাকা হাতে দেওয়ার নিয়ম নেই সরকারি সংস্থার। প্রতিবারই নানা কথা শুনতে হত। কিন্তু আর নয়। শুক্রবার রানিগঞ্জ ১ ব্লকের ইসলামপুরে মহিলা-পরিচালিত সমবায় ব্যাঙ্কে নিজের নামে অ্যাকাউন্ট খুলে খুশিতে ঝলমল করছিল বছর পঁচিশের চুমকির মুখ। পাশবইটা উল্টেপাল্টে দেখতে দেখতে বললেন, ‘‘নিজের আয়ের টাকা জমা পড়বে, ভাবতেই ভাল লাগছে।’’

মুর্শিদাবাদ জেলা কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কের তত্ত্বাবধানে ১৯ নভেম্বর রানিনগর-১ ব্লকের ইসলামপুরে মহিলা পরিচালিত ক্রেডিট সোসাইটির সূচনা হয়। শুক্রবার পর্যন্ত ২৪৩ জন মহিলা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলেছেন। তার মধ্যে এমন অনেকে আছেন, যাঁরা জীবনে প্রথম কোনও ব্যাঙ্কের চৌকাঠ পেরোলেন। এমনই একজন ইসলামপুর চকের হড়হড়িয়া বাগানপাড়ার ছবিতা দেবনাথ। একগাল হেসে এই মাঝবয়সী মহিলা বললেন, ‘‘পাড়ায় গিয়ে সকলকে বলেছি, আমার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট হয়েছে। অনেকে বিশ্বাসই করতে চাইছে না।’’

এই ব্যাঙ্কের কর্মী থেকে গ্রাহক, সকলেই মহিলা। পরিচালন সমিতিও মহিলাদের দখলে। নদিয়া, বাঁকুড়া, জলপাইগুড়িতে মহিলা-পরিচালিত সমবায় ব্যাঙ্ক থাকলেও, এই প্রথম মুর্শিদাবাদে চালু হল। মুর্শিদাবাদ জেলা কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কের আধিকারিক সমরেন্দ্র ভট্টাচার্য জানান, গ্রামীণ মহিলাদের উন্নয়নের জন্য জেলার প্রতিটি ব্লকে একটি করে মহিলা সমবায় ঋণদান সমিতি গঠন করার কথা। রানিনগরের পরে আরও তিনটি ব্লকে তাঁরা খুব তাড়াতাড়ি এমন মহিলা ক্রেডিট সোসাইটি খোলার চেষ্টা করছেন, যাতে গ্রামের মেয়েরা সহজে ব্যাঙ্কের সুবিধে পান। তিনি বলেন, ‘‘ব্যাঙ্কে মহিলা কর্মী থাকায় গ্রামের মহিলারা তাঁদের সুবিধা-অসুবিধার কথা মন খুলে বলতে পারবেন।’’

ব্যাঙ্ক পরিচালন সমিতির সম্পাদক অপর্ণা ভৌমিক জানান, নিজেদের নামে অ্যাকাউন্ট না থাকায় নানা ভাবে হয়রানি হয় মেয়েদের। প্রসূতির প্রাপ্য সরকারি অনুদানের চেক হাসপাতাল থেকে পেতে হয়রান হতে হয়। এলাকার পুরুষ যারা কাজের জন্য ভিন রাজ্যে গিয়েছেন, তাঁরা বাড়িতে টাকা পাঠাতে সমস্যায় পড়তেন। বাড়ির মহিলাদেরও অন্যের উপরে নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হত। ‘‘কিন্তু নিজের নামে অ্যাকাউন্ট থাকায় এখন থেকে সরাসরি সেখানেই টাকা পাঠানো যাবে। কন্যাশ্রী প্রকল্পের টাকাও পেতে অসুবিধে হবে না,’’ বলেন তিনি।

২৫৪টা গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে ৫৬টা গ্রাম পঞ্চায়েতে এখনও কোনও ব্যাঙ্ক নেই, বলছে বছর দুয়েক আগের একটি সমীক্ষা। ব্যাঙ্কের সুবিধে না পাওয়ায় গ্রামের মহিলাদের পক্ষে টাকা জমানো যেমন কঠিন, তেমনই সহজ শর্তে, কম সুদে ঋণ পাওয়াও কঠিন। অনেকে বেসরকারি লগ্নি সংস্থায় টাকা রেখে ঠকেছেন। গ্রামবাসীরা জানান, রোজ ভ্যালি, আই কোর, সারদা-সহ বেশ কিছু অর্থলগ্নি সংস্থা সক্রিয় ছিল। তাদের এজেন্ট হিসেবে যারা কাজ করতেন, তাঁদের অনেককে জমি, গরু বেচে শোধ করতে হয়েছে লগ্নিকারীর টাকা। তাই ব্যাঙ্কের প্রয়োজন তাঁরা ভালই বোঝেন।

আবার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক থাকলেও গরিব মেয়েদের খুব সুবিধে হয় না। স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্য মেয়েদের গ্রুপ অ্যাকাউন্ট থাকলেও, ব্যক্তিগত ঋণ নিতে গেলে সম্পত্তি দেখাতে হয়। ফলে সেই মহাজনের থেকে চড়া সুদে ঋণ নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। রানিনগর ১ ব্লকে এই মহিলা পরিচালিত সমবায় ব্যাঙ্ক সেই অসুবিধে মেটাবে। এখানে মেয়েরা টাকা জমাতে পারবেন সেভিংস অ্যাকাউন্টে, ঋণও নিতে পারবেন। রেকারিং ডিপোজিট এবং ফিক্সড ডিপোজিট প্রকল্পের সুবিধাও পাবেন।

এত দিন ইসমালপুরের মেয়েরা দাঁড়িয়েছেন পঞ্চায়েতের ভোটে। রানিনগর-১ ব্লকের ছ’টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে পাঁচটিতেই প্রধান পদে রয়েছেন মহিলা। এ বার তাঁরা দাঁড়াবেন সমবায় সমিতির ভোটেও। এখনও অবধি সমবায়ের সদস্য হয়েছেন প্রায় ৩৬৭ জন। এই সদস্যরা সমবায় সমিতির নির্বাচনে ভোটও দিতে পারবেন। নিজেদের আর্থিক হাল বদলাবেন নিজেরাই। প্রশাসনিক ক্ষমতার সঙ্গে আর্থিক ক্ষমতায়নের সুযোগ আসায় খুশি ইসলামপুর হাইস্কুলের শিক্ষিকা উমারানি গণাই। তাঁর আশা, ‘‘এ বার গোটা এলাকার ছবি বদলে যাবে।’’

এই মেয়েরাই একদিন তাক লাগিয়ে দেবে

সামসুন্নেসা

(ব্যাঙ্ক পরিচালন সমিতির চেয়ারপার্সন)

আমি রানিনগর ১ ব্লকের ২২টি শিশু শিক্ষা কেন্দ্রের সুপারভাইজার। আগে সাক্ষরতা মিশন প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত থাকায় গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঘুরে সাক্ষরতার কাজ করতে হত। গ্রামের মেয়েরা তখন তাঁদের কষ্ট-যন্ত্রণার কথা বলতেন। সকলেই বাড়িতে মুরগি-ছাগল পালন করে বিক্রি করতেন। কিন্তু সেটা টাকা জমানোর উপায় না থাকায় খরচ হয়ে যেত। ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট করতে গিয়ে ঘুরতে হত বারবার। অনেকের আবার ব্যাঙ্কে রাখার রসদও নেই। তখনই মেয়েদের জন্য একটা ব্যাঙ্ক খোলার কথা মাথায় আসে। দীর্ঘ দিন লেগে থাকার পরে এই সমবায় ব্যাঙ্ক তৈরি করা গেল। কেন এখানে অ্যাকাউন্ট খোলা দরকার, তা বাড়ি বাড়ি গিয়ে বুঝিয়েছি। সেই মেয়েরা আবার অন্যদের বুঝিয়েছে। গ্রামের কোনও গরিব মহিলা যে একদিন পরিচালন সমিতির চেয়ারপার্সন হবেন না, কে বলতে পারে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE