Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

বুথের কাছ থেকে সরছিস না কেন! বলেই শুরু মার

চারপাশ থেকে হিংস্র মুখগুলো এগিয়ে আসছিল। — শা...., তোকে তো তখন থেকে বলছি এখান থেকে চলে যা, যাচ্ছিস না কেন? বেশি রস? ভকভক করে এগিয়ে আসছে দিশি মদের গন্ধ। — সাংবাদিকতা ফলাচ্চিস? — কোন কাগজ? কোন কাগজ— গলার কাছে ভয়টা দলা পাকিয়ে উঠেছে তখন। কোনও রকমে ঢোঁক গিলে বলি— আনন্দবাজার... — আনন্দবাজার! ওহ্ শা...! তাই বলি, এত রস কেন! ভিড়ের মধ্যে থেকে এক জন চেঁচিয়ে ওঠে— ‘‘মার .... বাচ্চাকে। সিপিএমের দালালকে পুঁতে ফেল!’’ আর মুহূর্তের মধ্যে গোটা ভিড়টা আমার উপরে ভেঙে পড়ে। ছিটকে আসতে থাকে কিল, চড়, লাথি, ঘুষি। দু’হাত দিয়ে মাথাটাকে কোনও মতে বাঁচাচ্ছি! কাছেই পুলিশ বুথের সামনে থেকে ভিড় হটাতে চেষ্টা করছে। কিন্তু আমায় দেখতে পাচ্ছে না।... কে যেন ঘাড়ে ভারী কী দিয়ে মারল। মাঃ!

তাহেরপুরের ১১ নম্বর ওয়ার্ডে আনন্দবাজারের সাংবাদিক সুস্মিত হালদারকে (বাঁ দিকে) শাসাচ্ছে তৃণমূল কর্মীরা। এর পরেই শুরু হয় মার। তার আগে পর্যন্ত এটুকু ছবিই তোলা গিয়েছিল। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।

তাহেরপুরের ১১ নম্বর ওয়ার্ডে আনন্দবাজারের সাংবাদিক সুস্মিত হালদারকে (বাঁ দিকে) শাসাচ্ছে তৃণমূল কর্মীরা। এর পরেই শুরু হয় মার। তার আগে পর্যন্ত এটুকু ছবিই তোলা গিয়েছিল। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।

সুস্মিত হালদার
তাহেরপুর শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:১৩
Share: Save:

চারপাশ থেকে হিংস্র মুখগুলো এগিয়ে আসছিল।
— শা...., তোকে তো তখন থেকে বলছি এখান থেকে চলে যা, যাচ্ছিস না কেন? বেশি রস?
ভকভক করে এগিয়ে আসছে দিশি মদের গন্ধ।
— সাংবাদিকতা ফলাচ্চিস?
— কোন কাগজ? কোন কাগজ—
গলার কাছে ভয়টা দলা পাকিয়ে উঠেছে তখন। কোনও রকমে ঢোঁক গিলে বলি— আনন্দবাজার...
— আনন্দবাজার! ওহ্ শা...! তাই বলি, এত রস কেন!
ভিড়ের মধ্যে থেকে এক জন চেঁচিয়ে ওঠে— ‘‘মার .... বাচ্চাকে। সিপিএমের দালালকে পুঁতে ফেল!’’
আর মুহূর্তের মধ্যে গোটা ভিড়টা আমার উপরে ভেঙে পড়ে। ছিটকে আসতে থাকে কিল, চড়, লাথি, ঘুষি। দু’হাত দিয়ে মাথাটাকে কোনও মতে বাঁচাচ্ছি! কাছেই পুলিশ বুথের সামনে থেকে ভিড় হটাতে চেষ্টা করছে। কিন্তু আমায় দেখতে পাচ্ছে না।... কে যেন ঘাড়ে ভারী কী দিয়ে মারল। মাঃ!
নদিয়ার তাহেরপুর পুরসভায় ১১ নম্বর ওয়ার্ডে ১৮ নম্বর বুথে তৃণমূলের লোকেরা ছাপ্পার ‘স্লগ ওভার’ খেলবে বলে আগে থেকেই খবর ছিল। ভোট শেষ হতে তখন আর কয়েক মিনিট বাকি। বিধানচন্দ্র রূপান্তরিত নিম্ন বিদ্যালয়ের বুথের সামনে একটা ভিড় ক্রমশ ঘন হয়ে উঠছে। সেখান থেকে ছিটকে এসে নীল গেঞ্জি পরা এক যুবক বলে, ‘‘হাতে আর মোটে মিনিট পাঁচেক। আমাদের কাজ করতে দিন। এখান থেকে সরে যান।’’
বেগতিক বুঝে সহকর্মী চিত্রগ্রাহক সুদীপ ভট্টাচার্যকে সঙ্গে নিয়ে গুটি-গুটি পায়ে বুথ চত্বর ছেড়ে পাশেই একটা গাছের নীচে গিয়ে দাঁড়াই। এলাকার দায়িত্বে থাকা কোতোয়ালি থানার আইসি রাজকুমার মালাকারও চলে আসেন সেখানে। কথাবার্তা চলতে-বলতেই ফের দুই তৃণমূল কর্মী এসে আমাদের এলাকা ছেড়ে চলে যেতে বলে। তাদের মুখে তীব্র মদের গন্ধ। শুধু আমাদের দু’জনকে নয়, পুলিশকেও। আমরা আমল দিইনি।
হয়তো সেটাই ভুল হয়েছিল।
পাশে হাইস্কুলে ১২ নম্বর ওয়ার্ডের ১৯ নম্বর বুথ তখন প্রায় ফাঁকা। ওই বুথে সকাল থেকেই বহু ভোটারকে ভোট দিতে না দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল। তখনও আমাদের একাধিক বার বুথ ছেড়ে চলে যেতে বলা হয়। বেলা ১২টা নাগাদ মন্ত্রী উজ্জ্বল বিশ্বাস এলে তাঁর সামনে মারধরের অভিযোগ করেন মহিলা ভোটারেরা।
সেই ১৯ নম্বর থেকেও তৃণমূলের লোকজন ১৮ নম্বরের সামনে এসে জড়ো হচ্ছিল। সেখানে তখন অন্তত শ’দুয়েক লোক। অকথ্য গালিগালাজ করে তারা পুলিশ ও সংবাদমাধ্যমকে সরে যেতে বলছে। তা না হলে দেখে নেওয়ার হুমকিও দিচ্ছে। হঠাৎই একটু দূরে চিৎকার-চেঁচামেচি! দৌড়ে গিয়েই বুঝি বোকা বনেছি। আমাদের সরিয়ে দিতেই এই চাল! ফেরার চেষ্টা করতেই এক দল তৃণমূল কর্মী পথ আটকায়।
‘বারবার বুথের দিকে যেতে বারণ করছি, শুনছিস না কেন?’ —চিৎকার করে ওঠে এক জন। তর্কাতর্কি বেধে যায়। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে অন্তত জনা পঞ্চাশ তৃণমূল কর্মী আমাদের ঘিরে ফেলে। বুথের সামনেই পুলিশ। কিন্তু চেঁচিয়ে লাভ নেই। কেউ কিচ্ছু শুনতে পাবে না। সুদীপ ছবি তোলার জন্য ক্যামেরা তাক করতেই কয়েক জন সেটি টানাটানি শুরু করে দেয়। এ দিক ও দিক থেকে কয়েক ঘা পড়েও যায়। ইতিমধ্যে কয়েক জন আমায় ঠেলতে-ঠেলতে রাস্তার পাশে জঙ্গলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।
মেরেই দেবে না কি?
শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বইতে থাকে। কানে আগুন ছুটছে। হঠাৎ বোধহয় পুলিশের নজর পড়ে। দুই খাকি উর্দি ভিড় ঠেলে ঢুকে আমায় টেনে বের করে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তৃণমূলের লোকেরা পাল্টা ঠেলতে থাকে। এরই মধ্যে আইসি ঢুকে কোনও রকমে টেনে-হেঁচড়ে আমায় পাশের মাঠে রাখা গাড়ির দিকে নিয়ে যান। তখনও পিছন থেকে সমানে পিঠে কিল-চড় পড়ছে। দু’এক বার আইসি-র হাত থেকে আমায় ছিনিয়ে নেওয়ারও চেষ্টা হয়। অন্য পুলিশকর্মীরা ছুটে এসে সরিয়ে নিয়ে যান। কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল নির্বাচন কমিশনের লাল গাড়ি। সুদীপ ও এক ইংরেজি দৈনিকের চিত্রগ্রাহক সেখানে দাঁড়িয়ে। চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ।
তৃণমূলের লোকজন সেখানেও ধেয়ে আসছে দেখে তিন জন গাড়িতে উঠে পড়ে কাচ তুলে দিয়েছিলাম। কয়েক মিনিটের মধ্যে অন্তত শ’দুয়েক তৃণমূল কর্মী চারপাশ ঘিরে ফেলে আমায় তাদের হাতে তুলে দেওয়ার দাবি জানাতে থাকে। স্লোগান ওঠে— ‘‘আনন্দবাজার পত্রিকার সাংবাদিক হুঁশিয়ার!’’ আর বদ্ধ গাড়িতে কুলকুল করে ঘামতে-ঘামতে আমার মনে পড়তে থাকে, চৌমুহায় তাপস পালের কুকথার পরে খবর করতে গিয়ে তৃণমূলের তাড়া খাওয়ার কথা! ভয়ে বারবার ফোন করতে থাকি পুলিশ সুপার অর্ণব ঘোষ, তৃণমূলের জেলা সভাপতি গৌরীশঙ্কর দত্তদের। শেষে নাকাশিপাড়ার ওসি রাজা সরকার বাহিনী নিয়ে এসে পড়েন। পুলিশকে লাঠি নিয়ে তেড়ে আসতে দেখে তৃণমূলের লোকেরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। সেই সুযোগে আমাদের গাড়ি ছোটে।
ফেরার পরে অবশ্য গৌরীবাবুর ফোন আসে। খুবই আন্তরিক ভাবে তিনি বলেন, ‘‘খুব লেগেছে, না? এক বার ডাক্তার দেখিয়ে নেবেন কিন্তু!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE