Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

ভোটার কার্ড বেরোয় নদিয়ার বাসিন্দা বলে

ঘাট হয়েছে, আর নয়। ঠেকে শিখেছেন পানিঘাটা গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান মুজিবর রহমান। তিনি স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন, এলাকার বাসিন্দা হিসেবে কেউ শংসাপত্র পেতে চাইলে তিনটি শর্ত পূরণ করতে হবে। এক, লিখিত দরখাস্ত চাই। দুই, সেই আবেদনপত্রে স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য স্বাক্ষর করবেন, যার অর্থ, তিনি চেনেন আবেদনকারীকে।

নাসিরুল্লা।

নাসিরুল্লা।

সুরবেক বিশ্বাস
রাইপুর (নদিয়া) শেষ আপডেট: ২৯ মার্চ ২০১৫ ০৩:১৯
Share: Save:

ঘাট হয়েছে, আর নয়। ঠেকে শিখেছেন পানিঘাটা গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান মুজিবর রহমান। তিনি স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন, এলাকার বাসিন্দা হিসেবে কেউ শংসাপত্র পেতে চাইলে তিনটি শর্ত পূরণ করতে হবে। এক, লিখিত দরখাস্ত চাই। দুই, সেই আবেদনপত্রে স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য স্বাক্ষর করবেন, যার অর্থ, তিনি চেনেন আবেদনকারীকে। তিন, আবেদনকারীর সচিত্র ভোটার পরিচয়পত্রের ফোটোকপি লাগবে।

রাইপুর গ্রামে নিজের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে মধ্যবয়স্ক ওই ব্যক্তি বলছিলেন, “এই তিনটে শর্ত পূরণ করে আমার কাছে এলে তবেই পঞ্চায়েত প্রধান হিসেবে আমি কাউকে আবাসিক শংসাপত্র দেব। না হলে দেওয়ার প্রশ্নই নেই। অনেক শিক্ষা হয়েছে আমার। এখনও হাজতে যেতে হয়নি, সেটাই রক্ষে!”

কিশোরী কন্যার অসুস্থতা নিয়ে এমনিতেই দুশ্চিন্তার অন্ত নেই মুজিবরের। কিন্তু টানা দু’বারের পঞ্চায়েত প্রধানকে হাজতবাসের ভয় তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে কেন?

কারণটা আর কিছুই নয়, পানিঘাটা গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান আবাসিক শংসাপত্র দিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গে জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি)-এর প্রথম দায়িত্বপ্রাপ্ত জঙ্গি চাঁই ও খাগড়াগড় বিস্ফোরণ কাণ্ডের অন্যতম প্রধান অভিযুক্ত হাতকাটা নাসিরুল্লা ওরফে সুহেলকে। নিজেকে শাহদাত শেখ হিসেবে প্রতিপন্ন করে ওই শংসাপত্র পঞ্চায়েত প্রধানের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়ে মূলত সেই নথিরই দৌলতে ভারতের নির্বাচন কমিশনের সচিত্র ভোটার পরিচয়পত্র হাসিল করেছিল বাংলাদেশের নাগরিক নাসিরুল্লা।

পঞ্চায়েত প্রধান মুজিবর রহমান স্বীকারও করে নিচ্ছেন, “রাইপুরের বাসিন্দা হিসেবে দেখিয়ে নাসিরুল্লা ওরফে শাহদাতকে আবাসিক শংসাপত্র আমিই দিয়েছি। বছর পাঁচেক আগের ঘটনা। আর ওটা দিয়েই ও ভোটার পরিচয়পত্র বার করে নেয়। আমার গাফিলতি অস্বীকার করছি না। আসলে জনপ্রতিনিধি হিসেবে বাসিন্দাদের বহু অনুরোধ রাখতে হয়।”

রাইপুরের গা ঘেঁষা মির্জাপুর গ্রামেরই গিয়াসউদ্দিন মুন্সি ও মতিউর রহমানকে খাগড়াগড় মামলায় গত ২৯ জানুয়ারি গ্রেফতার করে জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ)। মির্জাপুর গ্রামে যে বছর একটি আবাসিক শিশু মাদ্রাসা তৈরি করে তার আড়ালে জঙ্গি কার্যকলাপ শুরুর তোড়জোড় হচ্ছিল, প্রায় তখনই নাসিরুল্লা ভুয়ো নামে ভোটার আইডি কার্ড হাসিল করে।

নাসিরুল্লা যে পঞ্চায়েত প্রধানের দেওয়া আবাসিক শংসাপত্রের সাহায্যে রাইপুর গ্রামের সাহদাত শেখ হিসেবে নিজেকে প্রতিপন্ন করে তার নামে জাল ভোটার আইডি কার্ড বার করে নিয়েছিল, তা জেনে মুজিবরকে দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করেন গোয়েন্দারা। কিন্তু তার পর তাঁরাও নিশ্চিত, পঞ্চায়েত প্রধান অসতর্কতাবশত ওই শংসাপত্র দিয়ে ফেলেছিলেন, তাঁর অন্য কোনও মতলব ছিল না। এক তদন্তকারী অফিসারের কথায়, “পানিঘাটার গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান ভুল করেছিলেন। তাঁর সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। এটাই আমরা তাঁকে বলেছি।”

স্থানীয় বাসিন্দাদের বক্তব্য, রাইপুর গ্রামের এক হতদরিদ্র মানুষের সঙ্গে নাসিরুল্লার যোগাযোগ হয়। এবং তাঁকে মোটা টাকা দিয়ে হাত করেছিল নাসিরুল্লা। পঞ্চায়েত প্রধান ও এনআইএ-র তদন্তকারীদের একাংশও বলছেন, টাকার লোভে পড়ে রাইপুরের বাসিন্দা ওই ব্যক্তি নাসিরুল্লাকে নিজের ছোট ভাই বলে পরিচয় দিয়েছিলেন। পঞ্চায়েত প্রধানকে ওই ব্যক্তি জানান, তাঁর ছোট ভাই শাহদাত কাজের সূত্রে মালদহে থাকে এবং রাইপুরের বাসিন্দা হিসেবে তার প্রধানের কাছ থেকে সার্টিফিকেট পেলে সুবিধে হবে।

এনআইএ সূত্রের খবর, রাইপুরের বাসিন্দা ব্যক্তিকে খাগড়াগড় মামলার সাক্ষী করা হতে পারে।

পঞ্চায়েত প্রধান মুজিবরের বাড়িও রাইপুর গ্রামে। মুজিবরের বক্তব্য, “আমার গ্রামের মানুষ মিথ্যা বলবেন, ভাবতে পারিনি। আর ওই সার্টিফিকেট কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের এক জন সন্ত্রাসবাদী ভারতের ভোটার আইডি বার করে নেবে, সেটাও বা কী করে বুঝব?”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE