অবশেষে ভক্তের নজরবন্দি হলেন ভগবান। নবদ্বীপের মন্দিরে বসল সিসিটিভি।
বিগ্রহ ও অন্য মূল্যবান সামগ্রীর ধারাবাহিক চুরি ঠেকাতে শেষ পর্যন্ত যাবতীয় দ্বিধা সরিয়ে মন্দিরে সিসিটিভি বসাতে রাজি হয়েছেন বিভিন্ন মঠ-মন্দির কর্তৃপক্ষ। শুক্রবার বলদেব মন্দিরে প্রথম সিসিটিভি বসানো হয়েছে। জানা গিয়েছে, এর পরে মদনমোহন মন্দির, জন্মস্থান আশ্রম, গোবিন্দ মন্দির, রাধারমণ বাগ সমাজবাড়ির মতো বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী মন্দিরেও সিসিটিভি বসানোর প্রস্তুতি চলেছে।
প্রাচীন শহর নবদ্বীপের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছে ছোট-বড় দেড় শতাধিক মঠ-মন্দির। এদের মধ্যে কয়েকটি সব দিক থেকে বিশালাকায়। বাকিগুলি মাঝারি বা একেবারেই ছোট। কিন্তু এই সব দেবালয়ের বেশির ভাগেই রয়েছে বহু প্রাচীন বিগ্রহ, পুথি, গ্রন্থ বা অন্য বহুমূল্য দ্রব্য। সারা দিন ভক্ত বা পর্যটকের ভিড় থাকলেও রাতে বেশির ভাগ মন্দিরে দু’এক জন আবাসিক ছাড়া তেমন কেউ থাকেন না। ওই সব মঠ-মন্দিরের উপরে চোর-দুষ্কৃতীদের নজর থাকে। কখনও চুরি হয়নি এমন কোনও মঠ বা মন্দির নবদ্বীপে খুঁজে পাওয়া ভার। দুষ্প্রাপ্য মূর্তি বা গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক নিদর্শন ছাড়াও অসংখ্য ছোট-বড় চুরির ঘটনা রয়েছে মঠমন্দিরে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এ সব চুরির কোনও কিনারা হয় না। সাধারণ ভাবে, কোনও মন্দিরে বড়সড় চুরি হলে কিছু দিন সরগরম থাকে শহর। তৎপরতা বাড়ে পুলিশের। এক সময়ে সব থিতিয়ে যায়। ফের শহরের আনাচে-কানাচে অরক্ষিত থাকে মূল্যবান বিগ্রহগুলি। গত ৭ মে, শনিবার সন্ধ্যা থেকে রবিবার ভোরের কয়েকটি ঘণ্টার মধ্যে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে তিনটি মন্দিরে চুরি হয়। খোয়া যায় বিগ্রহের হাতের মূল্যবান বাঁশি থেকে নগদ টাকা। এর পরেই ফের নড়েচড়ে বসেন মঠ-মন্দিরের প্রধানেরা।
২০১২ সালের মাঝামাঝি থেকে একটানা আট মাস শহরের বিভিন্ন মন্দিরে একের পর এক চুরি হয়েছিল। কোথাও বিগ্রহ, কোথাও অলঙ্কার তো কোথাও প্রাচীন মন্দিরের মূল্যবান স্মারক। শেষে রুপোর আস্ত সিংহাসন লোপাট করে দেয় চোরেরা। ২০১৩-র জানুয়ারির শেষে এক সপ্তাহের ব্যবধানে পরপর তিনটি মন্দিরে বড় মাপের চুরি হওয়ায় হুলুস্থূল পড়ে যায়। বাড়ে পুলিশি তৎপরতা। তার পর থেকে বছর তিনেক মঠ-মন্দিরে চুরির ঘটনা বড় একটা ঘটেনি।
কিন্তু মে মাসের প্রথম সপ্তাহে ফের কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে তিনটি মন্দিরে চুরির ঘটনা ঘটতেই তৎপর হয়ে ওঠেন বিভিন্ন মন্দির কর্তৃপক্ষ। গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজের প্রধানেরা মঠ-মন্দিরের নিরপত্তা চেয়ে পুলিশের কাছে লিখিত ভাবে দাবিও জানান। চুরির তদন্তও শুরু হয়। শহরের মঠ-মন্দির সংলগ্ন রাস্তায় বাড়ানো হয় রাতটহল। পাশাপাশি পুলিশের তরফ থেকে মঠ-মন্দির কর্তৃপক্ষকে মন্দিরের নিরাপত্তা রক্ষায় তাঁদের সাধ্য মতো উদ্যোগী হতেও অনুরোধ করা হয়। যাদের সামর্থ্য আছে তাঁদের সিসিটিভি ব্যবহার করার অনুরোধও জানানো পুলিশের তরফে।
কিন্তু মন্দিরে সিসিটিভি বসানো নিয়ে নবদ্বীপের বৈষ্ণব সমাজের অনেকেই প্রথমে রাজি ছিলেন না। ক্যামেরার নজরে দেবতাকে বন্দি করতে আপত্তি ছিল অনেক মন্দির প্রধানের। অবস্থার গুরুত্ব বুঝে মাঠে নামে গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজ। এ দিন যে মন্দিরে প্রথম সিসিটিভি বসল, সেই বলদেব মন্দিরের কিশোরকৃষ্ণ গোস্বামী গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজের সহ-সভাপতি (প্রশাসন)। তিনি জানান, এখনও অনেক প্রবীণ গোস্বামী ও সাধু আছেন যাঁরা মন্দিরে এ ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহারের ঘোরতর বিরোধী। তিনি বলেন, “কিন্তু তাঁদের আমরা বোঝাতে সক্ষম হয়েছি যে, মন্দিরে চুরির ঘটনা ঠেকানো যাচ্ছে না। মঠের সম্পত্তি, বিগ্রহ, অলঙ্কার সব কিছুতেই এখন দুষ্কৃতীদের নজর। প্রাচীন বিগ্রহ খোয়া গেলে অপূরণীয় ক্ষতি হয়।”
এক দিকে শহরে বহিরাগতের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। মন্দিরে মন্দিরে বাড়ছে অবাঞ্ছিত মানুষের ভিড়ও। অনেকেই নিছক মন্দির দেখতে আসেন না। এই সব ক্ষেত্রে নজরদারির জন্যও সিসিটিভি বসানো জরুরী। এই যুক্তি শেষ পর্যন্ত মেনে নিয়েছেন প্রবীণ বৈষ্ণব প্রধানেরা। জয় হয়েছে প্রযুক্তির। কিশোরকৃষ্ণ গোস্বামী বলেন, “আমাদের মন্দিরে আপাতত চারটি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। আরও কয়েকটি বসানোর পরিকল্পনা রয়েছে। নবদ্বীপের আরও চার-পাঁচটি মন্দিরে একে-একে সিসিটিভি বসছে।”
গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজের সম্পাদক অদ্বৈত দাস বলেন, “সব থেকে ভয়ে থাকি আমরা, যারা গঙ্গাতীরের কাছাকাছি থাকি। নবদ্বীপের উত্তর এবং পূর্ব দিক বরাবর গঙ্গা রয়েছে। নৌকা করে এসে কাজ সেরে দুষ্কৃতীরা সহজেই অন্যত্র পালিয়ে যেতে পারে। রাতের অন্ধকারে তাদের সামলাবো কী ভাবে? তাই নবদ্বীপের মঠ-মন্দির চোরেদের সহজ লক্ষ্য। আমরা মন্দিরে সিসিটিভির ব্যবস্থা করছি।”
ধামেশ্বর মহাপ্রভু মন্দিরের নিত্যসেবা পরিচালনা করে বিষ্ণুপ্রিয়া সমিতি। ওই সমিতির পক্ষে পুলক গোস্বামী বলেন, “এক বার চুরির পরে আমরা মন্দিরে রাতে মোট তিন জন মাইনে করা পাহারাদার রাখতে বাধ্য হয়েছি। তাঁরাই রাতে নিরাপত্তার দায়িত্ব সামলান। তবে আমরা রবিবার সমস্ত সেবাইতদের নিয়ে আলোচনায় বসছি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মন্দিরের নিরাপত্তায় আমরাও সিসিটিভি বসানোর ব্যবস্থা করব।”
এই প্রসঙ্গে নদিয়ার ডিএসপি (ডি অ্যান্ড টি) শেখ মহম্মদ আজিম জানিয়েছেন, “প্রযুক্তির এই ব্যবহারে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে গোটা নিরাপত্তা ব্যবস্থা। যন্ত্রের নজরদারি সব সময়েই অনেক বেশি নিখুঁত। এর পাশাপাশি পুলিশও যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে চুরির বিষয়টি দেখছে।”
সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো বা রাত পাহারাদার রাখার সামর্থ্য যাঁদের নেই তাঁরা জোর দিচ্ছেন স্থানীয় ভাবে নৈশরক্ষী বাহিনী চালু করার দিকে। গঙ্গার তীরবর্তী মঠ-মন্দির কর্তৃপক্ষ আবার চাইছেন জলপথে টহলদারির ব্যবস্থা করুক পুলিশ প্রশাসন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy